হাওড়া : সে অনেক কাল আগের কথা। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি। শিবপুরে তখন রায়চৌধুরী পরিবারের প্রতিপত্তিই আলাদা। পরিবারের শীর্ষে রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী। আদতে মুখোপাধ্যায় এই পরিবার রায়চৌধুরী পদবি পেয়েছিলেন বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের থেকে। তারপর থেকে এই পরিবার শতকের পর শতক এই পদবিই ব্যবহার করে আসছে। এই পরিবারের দুর্গাপুজোর সূচনা ১৬৮৫ সালে (মতান্তরে ১৬৮১ সালে)।  কিন্তু পুজোর শুরুর গল্পটা সবথেকে রোমাঞ্চকর। 
এই পরিবারের প্রবীণ সদস্য অরুণ রায়চৌধুরী এবিপি লাইভের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁর পারিবারিক পুজোর ইতিহাস ও পরম্পরার কথা। রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর ফুটফুটে কন্যা ছিল। সে রোজ দুপুরেই বাড়ির নিকটস্থ পুকুরপাড়ে খেলতে যেত। একদিন মেয়েকে বাবা জিগ্যেস করেন, ''মা তুমি কার সঙ্গে খেলতে যাও, তোমার সই কে?'' মেয়ে উত্তর দেয়, তাঁর বন্ধুর নাম পদ্মাবতী। অথচ রাজা তাঁর চেনা-পরিচিত-ঘনিষ্ঠ সকলকে জিগ্যেস করে জানতে পারেন, তাঁদের কারও মেয়ের নামই পদ্মাবতী নয়! তাহলে কে এই পদ্মা ? রাজা মেয়েকে দিয়ে বলে পাঠালেন একদিন বন্ধুকে বাড়িতে আসতে। পদ্মাবতী জবাব দিলেন, তিনি কারও ডাকে কারও বাড়ি যান না। যেখানে ইচ্ছে করে, সেখানেই যান। এত ছোট মেয়ের কথা শুনে রাজা তো অবাক, কিছুটা ক্রুদ্ধও। একদিন তিনি গেলেন মেয়ের সঙ্গে। দেখলেন তাঁর সইয়ের পায়ের ছাপ পুকুর পাড় অবধি গিয়ে জলে মিলিয়ে গেছে। রাজা মেয়েকে বলে দিলেন পদ্মাবতীর সঙ্গে আর না মিশতে। সেদিন রাতেই স্বপ্ন পেলেন রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী। পদ্মাবতী বললেন, তাঁকে পুজো করতে। কিন্তু রাজা বললেন, আমার পরিবারের নিত্যদেবী তো ব্যাতাইচণ্ডী। আমরা ওঁকে ছাড়া পুজো করব কী ভাবে। পদ্মাবতী জানালেন, তিনিই দুর্গা, তিনিই চণ্ডী। 


দেবীর কথা মতো সেই বছর থেকেই শুরু হল পুজো। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে পুজো হয়, সেই রীতিই অনুসরণ করা হয় এখানেও।
‘সাঁজের আটচালা’। হাওড়ার শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো হয় এই দালানেই। এই পুজো প্রায় ৩৪০ বছর ছুঁতে চলল। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে একই ধারায় হয়ে আসছে হাওড়ার অন্যতম অভিজাত পরিবারের পুজো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু রদবদল এলেও মূল ধারাটা একই রয়ে গেছে। দুর্গাপুজোর আগের নবমী তিথিতে এই পরিবারে বোধন বসে। কাঠামোর উপর দুইবার মাটি পড়ে যায়। পুরোহিতরা এসে মাকে আবাহন করেন এইদিনই। আগে এই দিন ব্রাহ্মণরা জড়ো হয়ে বিধান দিতেন। জড়ো হতেন ৫০-৬০ জন। 
সেদিন থেকেই পুজোর দালান সংলগ্ন বেলঘরে মা চণ্ডীর পুজো শুরু হয়। তাই প্রতিমার সামনে কোনও ঘট থাকে না। থাকে বেল ঘরেই। ওখানে মূল পুজো করেই বাইরে পুজো করা হয়। একই সঙ্গে পুজো যায় বেত্রচণ্ডিকা বা ব্যাতাইচণ্ডী মায়ের কাছে। সেই সঙ্গে উত্সর্গ করা হয় মা কালীকেও। আগে সপ্তমীতে ৭টি, অষ্টমীতে ৮টি, নবমীতে ৯টি বলিদানের রীতি ছিল। এখন সেই সংখ্যা কমে সপ্তমীতে ১ টি, অষ্টমীতে ১টি, সন্ধিপুজোয় ১টি ও নবমীতে ১ টি বলি হয়। নবমীতে আরও একটি বলি হয় ব্যাতাইচণ্ডী দেবীর কাছে। আগে সেখানে বলির পর দুর্গামণ্ডপে বলি হয়। তারপর বলিকাঠ উঠে যায়। 
সাদা ভোগ, খিচুড়ি ভোগ, লুচি ভোগ, নানা ধরনের ভোগ উত্সর্গ করা হয় দেবীকে। বিজয়া দশমীতে পান্তা ভোগ খেয়ে শিবগৃহে যাত্রা করেন। আগে কাঁধে করে বিজয়ার প্রথা থাকলেও, এখন তা হয় ট্রলি করেই।  গঙ্গার ঘাটে মাকে সাত-পাক ঘোরানোর কোনও রীতি নেই। বিজয়া করতে যাওয়ার আগেই গা থেকে সোনা-রুপোর গয়না খুলে নেওয়া হয়। বিসর্জনের আগে খুলে নেওয়া হয় মুকুটটি। সেই মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয় গৃহদেবী ব্যাতাইচণ্ডীকে। 
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে মা দুর্গা পূজিত হয়ে আসছেন শিবপুরের রায়চৌধুরী পরিবারের মা দুর্গা ও বেত্রচণ্ডিকা।