কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: এখানে দেবী দুর্গার স্থান মহাদেবের বাম ঊরুতে। দেবী এখানে দশভুজা নন। নেই মহিষাসুরও। কিন্তু পাশে রয়েছেন সন্তানরা। বাহন রয়েছে গণেশ ও কার্তিকের। কিন্তু লক্ষ্মী ও সরস্বতীর বাহন নেই। পূর্ব বর্ধমানের বড়শুলের 'দে' বাড়িতে হরগৌরী রূপেই পূজিতা হন দেবী দুর্গা। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, আড়াইশো বছর ধরে এভাবেই এখানে পুজো পাচ্ছেন হরগৌরি।
কী ভাবে শুরু পুজো?
দে পরিবারের এই দুর্গা পুজো ঘিরে রয়েছে একাধিক গল্প-কথা। পুজোর প্রচলন নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী। বড়শুলের জমিদার বাড়ির প্রধান তখন ছিলেন যাদব চন্দ্র দে। প্রথমে তিনি পুজো শুরু করেন। পরে ওই বংশের জমিদার গৌরপ্রসাদ দে'র আমল থেকে মূর্তিপুজো শুরু হয়। জমিদার বাড়িতে কীভাবে হরগৌরির মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হল?
নানা কাহিনি:
কথিত রয়েছে, এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের কেউ স্বপ্নাদেশ পেয়ে হরগৌরির আরাধনা শুরু করেন। অন্য় একটি কাহিনিও জুড়ে রয়েছে এর সঙ্গে। একসময় নাকি এই জমিদারবাড়িতে সাধুসন্তরা এসে থাকতেন। কথিত আছে, জমিদার গৌরপ্রসাদ দে'র আমলে তেমনই সাধু এসে ঝোলা থেকে বেশ কয়েকটি ছবি বের করেছিলেন। তারপরে পরিবারের এক কন্যাশিশুর চোখ বেঁধে একটি ছবি তুলতে বলেছিলেন তাঁরা। সেই শিশুকন্যা হরগৌরির ছবিটি তুলেছিল। সেই থেকেই হরগৌরির পুজো শুরু হয় এখানে।
কীভাবে পুজো? বাতলে দিলেন গুরুদেব:
এই পরিবার বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। তাই তখন তাঁরা গুরুদেবের শরণাপন্ন হন, কী রীতিতে দেবীর আরাধনা করা হবে। পরিবারের বর্তমান সদস্য হিমাদ্রীশঙ্কর দে জানান, গুরুদেবের পরামর্শে শাক্ত মতে,গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা অনুসারে পুজো শুরু হয় এখানে। তাঁর পরামর্শেই সপ্তমীতে গোটা ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। অষ্টমীতে ছাগবলি হয়। নবমীতে তিনটে ছাঁচিকুমড়ো, চারটি শসা, বাতাবি লেবু ও মূলসহ তিনটি আখ বলি দেওয়া হয়। তবে বলি দেওয়া কোনও জিনিসই এই পরিবারের কেউ আহার করতে পারেন না। আগে সন্ধিপুজোয় বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা বাড়ির পুজোর কামানের আওয়াজ শুনে সন্ধিপুজোর বলিদান শুরু হতো। এখনও তা হয় না। সর্বমঙ্গলা মন্দিরে কামান দাগা কয়েক দশক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ঘড়িতে সময় দেখেই বলিদান হয়।
এই জমিদার পরিবারের একসময় তামাক ও লবণের কারবার ছিল। দামোদর নদ দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। সেই আমলের জমিদারির নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে বড়শুলের একটা বড় অংশে। জাতীয় সড়ক থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার গিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে গলি রাস্তা ধরে গেলেই পৌঁছনো যাবে দে বাড়িতে। অতীতের আভিজাত্য, ঐতিহ্য, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অট্টালিকা। পলেস্তারা খসে পড়েছে অনেক জায়গায়। ইটেও ক্ষয় ধরেছে। ঠাকুরবাড়িতে ঢোকার একটা সিংহদরজা ভেঙে গিয়েছিল, সেটা নতুন করে করতে হয়েছে। তবে কয়েকটি বাড়িতে এখনও পরিবারের কয়েকজন বসবাস করেন। বাকি ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। অনেকে অন্যত্র বসবাস করেন। কাছারি বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই রয়েছে ঠাকুরদালান। সেখানেই রয়েছেন হরগৌরি। একটু দূরে রয়েছে কুলদেবতা রাজরাজেশ্বরের জিউ মন্দির।
পরিবারের সদস্য হিমাদ্রীশঙ্কর দে জানান, একসময় ঠাকুরদালানে রেড়ির তেলে ঝাড়বাতি জ্বলে উঠতো। দুর্গাপুজো উপলক্ষে আলোয় ঝলমল করত গোটা জমিদার বাড়ি। ঠাকুরদালানের প্রবেশপথে ছিল বিশাল ঘণ্টা। সেইসব এখন চুরি হয়ে গিয়েছে। এখন বৈদ্যুতিক আলোতেই সাজানো হয়।
দশমীর দিনে দেবীকে বাঁশের মাচা বেঁধে কাঁধে করে গোটা গ্রাম ঘুরিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। আগের মতো আভিজাত্য নেই, চাকচিক্য নেই। তবুও স্মৃতি আর প্রথা আঁকড়েই এখনও চলে প্রাচীন এই দুর্গাপুজো।
আরও পড়ুন: শোলার মূর্তিতে পুজো, সপ্তমীতে হয় সিঁদুরখেলা, প্রাচীন এই পুজো ঘিরে রয়েছে গল্পও