কলকাতা: “একদিন কৈলাসেতে শিবের সনে বসিয়া পার্বতী কয়, দয়াময় নাই ওর যাইতে আমার মনে লয়।’’ পুজো মানেই তাঁর কাছে সুর, তাল, ছন্দের মেল বন্ধন। পুজো মানেই নানা গানের হাত ধরে আকাশে বাতাসে আগমনী সুরের গন্ধ। শুধু স্মৃতিমেদুরতাই নয়, তার সঙ্গে উৎসবে শিল্পের কারিকুরিও তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সাক্ষী থেকেছেন, সনাতনী ছোঁয়া থেকে কীভাবে আধুনিকতার রূপ পেয়েছে এই বাংলার পুজো (Durga Puja 2022)। আবার প্রিয় ছাত্র তথা প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কালিদাপ্রসাদ ভট্টাচার্যে চোখে দেখেছেন শিলচরের পুজোও। কবি-অধ্যাপক-শিক্ষাবিদ অভীক মজুমদারের (Aveek Majumder) স্মৃতিচারণায় উঠে এল নানা রঙের দিনগুলি।
ছেলেবেলার পুজো: কলকাতার প্রাণ কেন্দ্রে আমার জন্ম। ছাতাবাবুর বাজারের কাছেই আমার বাড়ি, বেড়ে ওঠা সেখানেই। কলকাতার পুজো কীভাবে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে, সেটা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখেছি। আমাদের ছেলেবেলায় অবশ্যই থিম পুজো ছিল না। প্রতিমার সাবেকি সাজ, আর এক চালায় ঠাকুর রেখেই হত পুজো। আমাদের ছোটবেলার সমাজ আর এখনকার সমাজ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সময় দুর্গাপুজো, আর এখনকার দুর্গাপুজোর মধ্যে একটা বড় ফারাক তৈরি হয়ে গিয়েছে।
পুজো মানেই গান: বাবা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। গান শুনতে বড় ভালবাসতেন ছেলেবেলা থেকেই সখ ছিল গান শোনা। সেই সময়কার রেকর্ড এখনও আছে। দুর্গাপুজোর সঙ্গে স্মৃতিতে গান জড়িয়ে আছে। “শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে,’’ তারই উল্টো পিঠে আবার ছিল “চলিলে আনন্দময়ী নিরানন্দ করে।’’ পুজোর আগে থেকেই এই গানগুলি বাবা রেকর্ড প্লেয়ারে বাজাতেন। সেটাই ছিল আমার কাছে আগমনী সুর। ছেলেবেলার স্মৃতিতে মিশে রয়েছে এই গানগুলি। এই গান আমার কাছে অন্তত পুজোর একটা অঙ্গ। রোদে মধ্যে, ছায়ার মধ্যে, সামান্য বৃষ্টির মধ্যে, কাশফুলের মধ্যে, হাসি কান্নার মধ্যে গান বেজে ওঠে আগমনী সুর হয়ে। তবে একটা বিষয়ে ছেলেবেলা থেকে এখনও পর্যন্ত ছেদ পড়েনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় মহিষাসুরমর্দিনী। বিভিন্ন বয়সের মহালয়া দিয়েই আমি একটা স্মৃতি অভিযান চালাতে পারি।
ছোটবেলা থেকে দুর্গাপুজো মানে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ানো নয়। দুর্গাপুজো একটা মিলনোৎসব। যেখানে আমার বাবার বন্ধু, মায়ের বন্ধু এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে গল্প, খাওয়া-দাওয়া করতেন। আমি ছেলেবেলা থেকেই খাদ্যরসিক। সকালের দিকটা কষ্ট করে বাড়িতে খেয়ে নিলেও, সন্ধেবেলা বা রাতের খাবারটা কোনও দোকান থেকেই আনা হত। সেটার কোনও পরিবর্তন হয়নি। বাবার মামার বাড়ি হল শোভাবাজার রাজবাড়ি। মনে আছে ঠাকুমার হাত ধরে পুজোর সময় যেতাম। পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে যেতাম পুজোর সময়। এখন যাই ছেলে-মেয়ের হাত ধরে। এটা একটা ঐতিহ্যের বিস্তারও বলা যেতে পারে। সেই দালান, ঠাকুরের মূর্তি একই রয়েছে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। মানুষগুলো পাল্টে গিয়েছে। পুজোর সময় রাজবাড়িতে একটা বিশেষ প্রসাদ তৈরি হয়। সেটা অবশ্য একই রয়ে গিয়ছে।
একটা জিনিস উল্লেখ করতেই হয়। এটা অবশ্য আমার ছেলেবেলায় ছিল না। সবাই পুরনো দিনকেই চমৎকার বলে বর্ণনা করে থাকেন। আমার এখনকার পুজোয় সবথেকে ভাল লাগে দুর্গাপুজোয় শিল্পীদের অংশ নেওয়া। আমাদের ছেলেবেলায় জাঁকজমক, জৌলুস অনেক কম ছিল। কুমোরটুলি নামজাদা মৃৎশিল্পীদের তৈরি প্রতিমা দুচোখ ভরে দেখতাম। সেই মূর্তির মূলত সনাতনী চেহারা ছিল। যেটা ছিল না সেটা হল শৈল্পিক ভাবনার প্রকাশ। সেটা নতুন একটা অভিমুখ তৈরি হয়েছে গত ২৫ বছরে। শিল্পীদের কল্পনা এবং তার প্রয়োগ আমি মুগ্ধ নয়নে দেখি। পুরনো নিয়ে অনেক স্মৃতিমেদুরতা সত্ত্বেও, এই অভিমুখ ছেলেবেলায় পাইনি। আধুনিক শিল্পের প্রয়োগ দুর্গাপুজোয় মূর্তি নির্মাণে, সাজসজ্জা, আবহ, প্যান্ডেল তৈরিতে দেখতে পাই।
কলকাতার দুর্গাপুজোর পাশাপাশি স্মৃতিতে রয়েছে পূর্বের রাজ্য অসম। আমার ছাত্র ছিলেন প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কালিদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। শিলচরের বর্ধিষ্ণু পরিবারের সন্তান কালিকা। ওঁর বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। পুজোর সময় শিলচরে যেত। ফিরে এসে সেই পুজোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা তুলে ধরত। তার সঙ্গে শোনাত ওদের বাড়ির দুর্গাপুজো গান। “কৈলাসেতে শিবের সনে বসিয়া পার্বতী কয়, দয়াময় নাই ওর যাইতে আমার মনে লয়’’- এই গানও প্রথম শুনিয়েছিল কালিকা। না, স্বচক্ষে সেই পুজো দেখা হয়নি। তবে কালিকার চোখে বহুবার ফিরে গিয়েছে শিলচরের সেই অদেখা জায়গাকে। ওঁর গল্পেই চিনেছি সেই উৎসবকে।
আরও পড়ুন: Durga Puja 2022: দেবীকে তুষ্ট করতে বলি হয় ছাঁচি কুমড়ো, সিংহ এখানে ঘোটকরূপী