অমিত জানা, পশ্চিম মেদিনীপুর: অষ্টাদশ শতক। তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কালাপাহাড়। তাঁর আক্রমণ থেকে বাঁচতে ওড়িশার পুরী থেকে পশ্চিমবঙ্গের নারায়ণগড় ব্লকের মকরামপুরে পালিয়ে আসেন ইন্দ্রজিৎ মহাপাত্র। কথিত রয়েছে, তিনি ওড়িশায় পুরীর মন্দিরের ঘণ্টা বাজাতেন, তাই তাঁর পরিচয় ছিল স্বর্ণঘণ্টি মহাপাত্র। পুরী থেকে যখন পালিয়ে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিল বৃন্দাবন জিউ, রাধা-কৃষ্ণ ও গোপালের মূর্তি। যতই বিপদ আসুক, কুলদেবতার পুজো সবসময়েই হয়ে আসছে এই বাড়িতে। তারপর আবার নারায়ণগড় ব্লক থেকে অন্যত্র সরে আসেন তাঁরা। জঙ্গলঘেরা জায়গা, দস্যুদের আক্রমণের ফলে নারায়ণগড় থেকে অবিভক্ত মেদিনীপুরের এগরা হয়ে অধুনা দাঁতন ২ ব্লকের কৃষ্ণপুর গ্রামে আসেন ইন্দ্রজিৎ মহাপাত্র। সেই সময়ে ইংরেজ শাসন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমিদারি নেন তিনি। তারপর সেখানেই মন্দির গড়ে শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। সেই পুজো পেরিয়েছে ২০০ বছরেরও বেশি সময়। 


এক পোয়া জমিদারি:
কথিত রয়েছে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যতটা এলাকা ঘোড়ায় ঘুরে আসতে পারবেন ততটাই জমিদারি হতো। ইন্দ্রজিৎ মহাপাত্রের পুত্র রত্নেশ্বর ঘোড়ায় এক পোয়া জায়গা প্রদক্ষিণ করেন। আর সেই থেকে জমিদারির নাম হয় পুঁয়া গড়। আর সেখানেই কুলো দেবতার মন্দির নির্মাণ করেন। মূল মন্দিরের গৃহের সামনে চারটি করে বারান্দায় যুক্ত প্রকোষ্ঠ। বর্তমানে নাট মন্দিরটি প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন করে তৈরি হয়েছে আর পাশেই দেবতার মন্দিরের গায়ে রয়েছে দুর্গা মন্দির।


বন্ধ হয়ে যায় বলি:
তৎকালীন জমিদার বাড়িতে প্রজাদের মঙ্গল কামনায় শুরু হয় দুর্গাপুজো। জমিদার বাড়ির এই দুর্গাপুজো ১৭ দিন ধরে চলত। কথিত রয়েছে, জমিদার বাড়ির এই দুর্গাপুজোয় যে যা মানত করতো তাই ফলত। এর সঙ্গেই শুরু হয় বলি প্রথা। সপ্তমীতে সাতটি পাঁঠা, অষ্টমীতে আটটি পাঁঠা, নবমীতে নটি পাঁঠা বলি হতো। পরে বলি বন্ধ হয়ে যায়। তার পিছনেও রয়েছে একটি ঘটনা। পুজোর মধ্যে একদিন দুর্যোগ হয়। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে ওই এলাকায় বহু ঘর-বাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাসিন্দারা। সেদিন ছিল সপ্তমী। সপ্তমীর দুর্যোগের রাতে প্রজাদের আশ্রয় দিতে ভিড় হয়ে যায় তাই সেদিনের পাঁঠা বলি আর হয়নি। অষ্টমীর ভোরে দেখা যায় সাতটি পাঁঠা মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অমঙ্গলের আশঙ্কায় বন্ধ হয়ে যায় পাঁঠা বলি। তবে তার জায়গায় চালকুমড়ো ও আখ বলির প্রথা চলে আসছে।


দেবীর ভোগ:
দেবীর পুজোর ভোগে থাকে সকালে খিচুড়ি এবং রাতে পোনা মাছে। আগে চন্ডীমঙ্গল গান হলেও এখন সেটা আর হয় না। দুর্গা দেবীর মন্ডপের পাশেই রয়েছে বৃন্দাবনজীউ কুলো দেবতার মন্দির, সেখানে আরতি শেষ হলেই দুর্গা দেবীর সন্ধ্যা আরতি হয়। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নিয়মেই দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। আগের মতন আর জমিদারি অবশ্য আর নেই। তাই  জাঁকজমক কমলেও ঐতিহ্য এখনও অম্লান।


জমিদার বাড়ির সদস্য সিতাংশু শেখর রায় মহাপাত্র বলেন, 'আগের ১৭ দিন ধরে পুজো হতো, এখন টাকার অভাবে ষষ্ঠী থেকে পুজো শুরু হয়। দশমীর দিন আত্মীয়-স্বজন গ্রামবাসীরা বসে প্রসাদ সেবন করি। পুজোর প্রথম দিন থেকেই জমিদারের পুকুরের থেকে মাছ ধরে নিয়ে এসে দেবীর কাছে নিবেদন করা হতো। এখনো সেই নিয়ম চলে আসছে।' আর এক সদস্য শান্তি রানি রায় মহাপাত্র বলেন, 'আমাদের বাড়িতে যেভাবে পুজো হয় এই ধরনের পুজো কোথাও হয় না। গ্রামের লোকেরাও এসে পুজোতে আনন্দ উপভোগ করেন।'

আরও পড়ুন: বেহাল রাস্তা মরণফাঁদ, মাছ ছেড়ে বিক্ষোভ স্থানীয়দের