কলকাতা: আশ্বিন মাসের রাত। পল্লিগ্রামের চারদিক বেশ নিস্তব্ধ। বড় বড় নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের চাঁদ। চারদিকে একটা হালকা কুয়াশার চাদর যেন ছেয়ে রয়েছে পুরো এলাকা। রাতের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত অজস্র গাছপালায় ঢাকা অঞ্চলটাকে যেন আরও নিস্তব্ধ করে তুলেছে।
নিশুতি রাতে গ্রামের একটা বাড়ি থেকে দরজা খুলে এক ব্যক্তি বন্দুক হাতে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। কিছুদূর হাঁটার পর আকাশের দিকে তাক করে বন্দুক দাগলো। গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেদ করে বন্দুকের আওয়াজ ছড়িয়ে গেল চারদিকে। হঠাৎই পুরো গ্রামটা যেন জেগে উঠলো। চারদিক ঢাক ঢোল কাঁসরঘন্টার আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠলো। শুরু হল মহা অষ্টমীর সন্ধিপুজো।
দুর্গাপুজোর এরকমই বর্ণনা পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোর ইতিহাসে। তখনকার দিনে সবার বাড়িতে ঘড়ি থাকত না। সেজন্য বন্দুক বা তোপ দেগে সন্ধি পুজোর সময় জানান দেওয়া হত। সেকালে জমিদার বা রাজা না হয়েও বঙ্কিমচন্দ্রের পল্লিগ্রাম বাড়ির পুজো যেরকম জাঁকজমক করে করা হত, তা টেক্কা দিত শহর কলকাতার বড় বড় রাজা, জমিদারবাড়ির পুজোকে।
তখনকার যুগে মোবাইল, ক্যামেরা বা সোশাল মিডিয়া ছিলনা। ফলে সে যুগের পুজোর চিত্র বোঝার ভরসা নানাজনের লেখনিতে উঠে আসা পুজোর বর্ণনা। সেরকমই বিবরণ পাওয়া যায় নানা লেখনীতে।
নৈহাটির বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি সেজে উঠেছে শারদীয়া পুজোর আনন্দে। বাড়ির চারদিকে আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। পুজো মণ্ডপ তো বটেই, বাড়ির কার্নিশ জানালা ও চারপাশের যেখানে যা জায়গা ছিল সেখানে মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে পুরো বাড়িটা আলোকিত করা হয়েছে। কয়েকটি বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। শরতের হালকা হিমেল হাওয়ায় কোনও প্রদীপের আলো যদি নিভে যায় সেটাকে ফের চট করে আবার জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য তৎপর তারা। পুজোর দালান পুজোর রাতে মোহময় হয়ে উঠেছে। সেখানেও প্রদীপের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারিদিক গাছপালায় ছাওয়া পল্লি গ্রামের মধ্যে সাদা রঙের এই দোতলা বাড়িটি সবারই চোখ কাড়ে। এবাড়ির পুজো-অর্চনা সবই রাজা জমিদার বাড়ির মত জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ির দুর্গাপুজোর এরকমই বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়।
বঙ্কিমচন্দ্রর বাবা যাদবচন্দ্র ছিলেন সরকারি আমলা। বঙ্কিমচন্দ্রের পরিবারের অর্থনৈতিক কোন সমস্যা ছিল না। বেশ বড়লোকই বলা যেতে পারে তাদের। জমিদার বা রাজা না হয়েও একটা জমিদারি চাল ছিল এই পরিবারের। নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বিখ্যাত চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সামাজিক মান মর্যাদা এবং খ্যাতি অনেকটাই বেড়েছিল যাদবচন্দ্রের সময় থেকে। যদিও চট্টোপাধ্যায় পরিবার কাঁঠালপাড়ায় প্রাচীন অধিবাসী। চট্টোপাধ্যায় পরিবার নৈহাটির আদিবাসীন্দা হলেও যাদবচন্দ্রর সময় থেকে পরিবারের নামডাক বাড়তে থাকে। যাদবচন্দ্র ১৮৫২ সালে কাঁঠালপাড়ার বাড়ি দোতলা প্রাসাদের মত তৈরি করার পর সেখানে দুর্গাপুজো শুরু করেন।
বাড়ির উত্তর দিকে একটি ঠাকুরদালান তৈরি করে সেখানে সারা বছর জুড়ে নানা পুজো অর্চনার সঙ্গে দুর্গাপুজো শুরু হয়। যাদবচন্দ্রর একটা দানপত্র থেকে জানা যায়, চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর খরচ-খরচার দায়িত্ব দেওয়া ছিল সেজো ছেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপর। কারণ ছেলেদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন আর্থিক দিকথেকে বেশ সচ্ছল। মোটা মাইনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে চাকরি করার সুবাদে বঙ্কিমচন্দ্রের পয়সা কড়ির কোন অভাব ছিল না। বরং বছর বছর তার বেতন বৃদ্ধি হয়ে তা এক বিপুল সংখ্যায় দাঁড়িয়েছিল সে যুগের নিরিখে।
বঙ্কিমচন্দ্র বাড়ির দুর্গাপুজোর চমক ছিল দেখার মত। সে যুগের বর্ণনায় পাই বঙ্কিমচন্দ্র বাড়ির পুজোর নানা বিবরণ। অন্য বিষয়ে যাওয়ার আগে একবার দেখে নেয়া যাক কেমন কি খরচা হতো সে যুগের বনেদিবাড়ির দুর্গাপুজোয়। ১৮৮৩ সালের পুজোর খরচের থেকে জানা যায়, সেবার বঙ্কিমচন্দ্র বাড়ির শারদ উৎসবে মোট খরচ হয়েছিল ৪০৯ টাকা ছ’ আনা এবং আধ পয়সা! তার মধ্যে প্রতিমার খরচ ছিল ৫১ টাকার মত, পুজোর খরচ ৬২ টাকা, নৈবেদ্য ২১ টাকা। আর সব থেকে বেশি খরচ হয়েছিল তা ছিল ভোগপ্রসাদের, ১৭৬ টাকার মতো।
পুজোর দিনগুলোতে পুরো গ্রামবাসীর আমন্ত্রণ চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে। দু-বেলা পাত পেড়ে বসে ভোগ খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আর বলাই বাহুল্য, তৎকালীন লোকজনদের ঠাকুরের কৃপায় খোরাকিটা নেহাত কম ছিল না। যে যুগে এক এক ব্যক্তি আস্ত পাঠা খেয়ে হজম করা বা আস্ত কাঁঠাল খেয়ে ফেলার ঐতিহ্যের কথা শোনা যায় সেখানে চট্টোপাধ্যায় বাড়ির উৎকৃষ্ট মানের প্রসাদ সদ্ব্যবহারে যে পিছপা হতনা তা বলাই বাহুল্য।
বঙ্কিমচন্দ্র নিজে যেমন টিপটপ ফিটফাট থাকতে ভালোবাসতেন, তেমনি সর্বদিক থেকেই তাঁর রুচির প্রকাশ পাওয়া যায়। বাড়ির দুর্গাপুজোয় তার কোন ব্যতিক্রম ছিল না। টপ ক্লাস মেনটেন করতেন সব বিষয়ে। পুজোর সময় ঠাকুর গড়ার কাজ করত সেকালের কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির বিখ্যাত কুম্ভকার শশীপাল ঠাকুর। দুর্গা মণ্ডপের পিছনে চালচিত্র আঁকার জন্য চুঁচুড়া থেকে সে সময়কার বিখ্যাত চিত্রকর মহেশ ও বীরচাঁদ সূত্রধর আসতেন। চন্ডী মন্ডপে গান গাইতে আসতেন জগমোহন স্বর্ণকার। পুজোর কদিন নিয়মিত বসত গানের আসর। বঙ্কিমচন্দ্র গান ভালবাসতেন, নিজে একসময় গান শিখেওছিলেন। দুর্গামন্ডপে জলসার আসরে রামায়ণ গান গাইতে আসতেন নীলকমল। যাত্রাপালার গান ভালবাসতেন, সে জন্য আসতেন বদন অধিকারী , গোবিন্দ অধিকারীরা। দুর্গাপুজোর দিনগুলোকে কেন্দ্র করে গানের আসরে যাত্রাঅঙ্গ, রামায়ণী গানের সঙ্গে চলত সহচরী, যাদুমণির কীর্তন, মধুকানের গান গাওয়া হতো। গানের পর্ব চলত পালা করে আর তার জন্য আসতেন সেসব গানের নাম করা শিল্পীরা। চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে পুজোর কদিন যেন চাঁদের হাট বসত দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে।
পুজোকে নিয়ে বাংলায় কবিতার শেষ নেই। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করে লিখেছেন "বর্ষে বর্ষে এসে মাগো খাও লুচি পাঁটা/ ছোলা কলা কচু ঘেঁচু যা জোটে কপালে/ যে হোল দেশের দশা, নাই বড় সে ভরসা/ আসবে যাবে খাবে নেবে সম্বৎসর কালে।"
১৮৭৪ সালে তাঁর বাবার আমলে বাড়ির পুজো দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তার লেখনীতে কমলাকান্ত দপ্তরে আমার দুর্গোৎসব নামক একটি প্রবন্ধ পাওয়া যায়। কমলাকান্তের বকলমে পাওয়া যায় শারদীয় উৎসবের এক বর্ণনা।
“দেখিলাম অকস্মাৎ কালের স্রোত, দিগন্ত ব্যাপিয়া প্রবল বেগে ছুটিতেছে- আমি ভেলায় চড়িয়া ভাসিয়া যাইতেছি। দেখিলাম—অনন্ত, অকূল, অন্ধকারে, ব্যাত্যাবিক্ষুব্ধ তরঙ্গসঙ্কুল সেই স্রোত-- মধ্যে মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্রগণ উদয় হইতেছে, নিবিতেছে-- আবার উঠিতেছে। …. সহসা স্বর্গীয় বাদ্যে কর্ণরন্ধ্র পরিপূর্ণ হইল…। সেই তরঙ্গ সংকুল জলরাশির ওপরে দূরপ্রান্তে দেখিলাম—সুবর্ণমন্ডিতা, এই সপ্তমীর শারদীয় প্রতিমা। জলে হাসিতেছে, ভাসিতেছে, আলোক বিকীর্ণ করিতেছে! রত্নমন্ডিত দশ ভুজ- দশ দিক- দশ দিকে প্রসারিত তাহাতে নানা আয়ুধরূপে নানা শক্তি শোভিত; পদতলে শত্রু-বিমর্দ্দিত বীরজন কেশরী শত্রু নিস্পীড়নে নিযুক্ত! এ মূর্তি এখন দেখিব না- আজি দেখিব না, কাল দেখিব না..।“
কমলাকান্তের বর্ণনায়, ‘বড় পুজোয় ধুম বাধিবে। কত ব্রাহ্মণপণ্ডিত লুচি মণ্ডার লোভে বঙ্গোপূজোয় আসিয়া পাতরা মারিবে-- কত দেশী-বিদেশি ভদ্রাভদ্র আসিয়া মায়ের চরণে প্রণামী দিবে-- কত দিন দুঃখী প্রসাদ খাইয়া উদর পুরিবে। কত নর্ত্তকী নাচিবে, কত গায়কে মঙ্গল গায়িবে, কত কোটি ভক্তে ডাকিবে, মা! মা! মা!”
দুর্গাজননী থেকে বঙ্গজননীর রূপান্তর দেখা যায়, যা পরে পূর্ণতা পায় কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে। বঙ্গদর্শনের ১৮৭৪ সালে, বাংলার ১২৮১ সালের কার্তিক সংখ্যায় কমলাকান্তের জবানে “আমার দুর্গোৎসব" প্রবন্ধটি ছাপা হয়। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে এসে আশ্বিন মাসে বাড়ির পুজো দেখে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শনের লেখাটি লেখেন।
পুজোর সময় শাসক ইংরেজ অংশ নিত সে আনন্দ উৎসবে। তাঁদের সবচেয়ে বিক্রিত পত্রিকা ইংলিশম্যানের পাতায় পাতায় লেখা থাকত সে বছর কোন কোন পুজো সবচেয়ে "স্পেন্ডিড" হতে পারে, তার বিবরণ। কোথায় কোন বাঈজি আসছে, কোন বাড়ি কেমন করে সাজানো হচ্ছে, তার গল্পেই গোটা কাগজ ভরা থাকত।
একবার পুজোর সময় বঙ্কিমচন্দ্র বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন চুঁচুড়ায়। বাবা যাদব চন্দ্র উইলে বঙ্কিমকে কাঁঠালপাড়ার বাড়ির অংশ দেননি। ভাইদের মধ্যে পারিবারিক বিবাদ বেড়ে উঠেছিল। ঠিক যেমনটা হয়ে থাকে আর পাঁচটা বাঙালি পরিবারে, চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে তার ব্যতিক্রম ছিল না। ভাই ভাইয়ের মধ্যে সুক্ষ হলেও অর্থনৈতিক কারণে জন্য একটা বিবাদ বা মনোমালিন্য থেকেই যেত।
উইলে তাঁকে কোন অংশ দেওয়া হয়নি, সেই অভিমানে ১৮৭৭ সালের গোড়ার দিকে বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়ার বাস উঠিয়ে চলে গেলেন গঙ্গার ওপর পারে চুঁচুড়ায়। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতে লাগলেন। তখন তিনি অবশ্য কাজও করতেন গঙ্গার ওপারে। ফলে যাতায়াতের সুবিধা এই ঘটনার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল। সেবার কাঁঠালপাড়ার পারিবারিক পুজোতে তিনি আসেননি। কিন্তু নিয়ম মেনে তার দায়িত্ব অনুসারে পুজোর খরচাপাতি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পৈত্রিক বাড়িতে। বাবাকে লেখা একটি চিঠিতে আমরা পাই, বঙ্কিমচন্দ্র লিখছেন, “পূজার দ্রব্যসামগ্রী পূর্ণচন্দ্রের ভান্ডারে রাখাইবেন এবং পূজার কর্মের ভার বিপিনের মাতাকে দিবেন। পূজার সময় আমাদিগের কাঁঠালপাড়া যাইবার সম্ভাবনা নাই…”
বঙ্কিমচন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র। বিপিন পূর্ণচন্দ্রের বড় ছেলে, তাকে খুবই স্নেহ করতেন বঙ্কিমচন্দ্র। চট্টোপাধ্যায় বাড়ির সে আমলে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা অবধি খরচ হতো শুধুমাত্র দুর্গাপুজোতে। পুজোর খরচা বাবদ বঙ্কিমচন্দ্র দিতেন প্রায় আড়াইশো টাকা। পূর্ণচন্দ্র দিতেন দেড়শো টাকার কাছাকাছি। সর্বমোট ৪০০ টাকার পুজো। সন্দীপচন্দ্রকে লেখা চিঠিতে এসব পুজোর খরচা খরচের একটা হিসেব পাওয়া যায়। সেটা ১৮৮৭ সাল। তিনি তখন মেদিনীপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সে আমলে ৪০০ টাকা এখনকার হিসাবে অকল্পনীয়। বিশেষ করে কোন পারিবারিক পুজোর খরচে। ১৮৭০ সালে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৭০০ টাকা। সেটা কত টাকা তা বুঝতে একটা উদাহরণ যথেষ্ট, এক টাকায় পাওয়া যেত ২৪ সের চাল !
কলকাতায় বাড়ি করার পর সেখানে দুর্গাপুজো করার পরিকল্পনাও যা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাঁঠালপাড়ার পারিবারিক পুজো বাদ দিয়ে কলকাতায় আলাদা করে কোন পুজো তিনি শুরু করেননি। কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি পুরনো বাড়ি কিনে সেখানে বহু বছর ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
বঙ্কিমচন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথায় চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর কিছু ছবি পাওয়া যায়। পুজোর দালানে চারদিক প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। দেবী মূর্তির সামনে থেকে শুরু করে উঠোনে নামার সিঁড়ি পর্যন্ত করা হয়েছে প্রদীপের সারি। ঢাকঢোল সহকারে সন্ধিপুজোর শুরু হল। কিছুক্ষণ পরে ঢাকঢোল বাজনা বন্ধ হওয়ার পর মাতৃ প্রতিমার সামনে পুরোহিত ও তন্ত্রধারীর মন্ত্র উচ্চারণ শব্দ শোনা যেতে লাগলো। দালানের মধ্যে সিংহবাহিনী অসুরের মধ্যে মৃন্ময়ী মা বাড়ি আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে পাহাড় হয়ে রয়েছে বেলপাতা ও নানা রকম ফুল। তার মধ্যে পদ্ম ফুলের ভাগে বেশি। তার সামনে বসেই পুরোহিত। মন্ডপের মধ্যেই একটি থামে হেলান দিয়ে পৃথকাসনে বসে আছেন এক ব্যক্তি বঙ্কিমচন্দ্রের বাবা। একটি চাদরে গা ঢাকা। সহাস্যে বসে আছেন বাড়ির মালিক ও রায়বাহাদুর।
সন্ধি পুজোর সময় মন্ডপে এসে উপস্থিত হলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। একটি থামে হেলান দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন মৃন্ময়ী মায়ের দিকে। তখন বঙ্কিমচন্দ্রের বয়স ৩৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। গোঁফের চুল পাকতে আরম্ভ করেছে। মাথার চুলে দেখা যাচ্ছে রূপালি রেখা। তিনি অনেকক্ষণ স্থির ভাবে তাকিয়ে রইলেন প্রতিমার দিকে। মুখে কোন কথা নেই।
বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গাপুজোর বিবরণ পাওয়া যায় তার ভাইপো শচীশচন্দ্রের বর্ণনা থেকে। তিনি লিখছেন, দুর্গাপূজার সময় দেবী প্রতিমার পায়ের তলায় বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রণাম করতে দেখেছি। কিন্তু সে প্রণামে বৈচিত্র্য বা বিশেষ ভক্তি দেখা যায়নি। সাধারণ লোকে যেরকম প্রণাম করতেন। কিন্তু একবার সন্ধি পুজোর সময় তার যে মূর্তি দেখেছিলাম সেরকম আর কখনো দেখিনি। দালানের এক কোণে প্রতিমা থেকে বেশ খানিকটা দূরে হেলান দিয়ে একা নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার দৃষ্টি প্রতিমা দিকে হলেও তা যেন প্রতিমা লক্ষ্য নয়। আরো কোন সুদূর গহনে গভীরে তার ভাবনা লোকে তিনি বিভোর হয়েছিলেন।
১৮৯৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও তার পারিবারিক দুর্গাপুজো বন্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯২৪ সাল নাগাদ একবার চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোর সময় আরতি চলাকালীন প্রতিমা চুলে আগুন ধরে পুড়ে যায়। সে বছর পুজোয় বিঘ্ন ঘটে। পরের বছর থেকে সেই ঐতিহ্যবাহী পুজোটি বন্ধ হয়ে যায়। অন্যতম কারণ অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পর পুজোর খরচ যোগান দেওয়ার লোকের অভাব। তাঁর মতো আয় ও সে অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে খরচা করার মত সামর্থ্য বা ইচ্ছা পরবর্তীকালে সে বংশের লোকজনদের মধ্যে কমে আসে।
পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সুবিশাল দুর্গামন্ডপ জীর্ণ হতে থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমশ ভাঙতে থাকে। ১৯৬২ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি সরকারি অধীনে আসার পর চট্টোপাধ্যায় পরিবারের লোকজন এই অংশটি রক্ষণাবেক্ষণের আর তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। একসময় সংস্কার ও নজরদারির অভাবে ভেঙে পড়ে ঐতিহ্যবাহী দুর্গামন্ডপটি। ১৯৯৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের বসত বাড়ি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে “বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্র” স্থাপিত হওয়ার পর বাড়ি সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সেই সঙ্গে পুজামন্ডপের ভেঙে পড়া অংশটি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যে নতুন করে গড়ে তোলা হয় ঠিক পুরনো দুর্গা মন্ডপের আদতে। এর নামকরণ করা হয়েছে সঞ্জীবচন্দ্র সভাগৃহ।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়র জন্মভিটে তথা বসতবাড়িটি বর্তমানে বঙ্কিম গবেষণাকেন্দ্র। যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও দুর্গাসুন্দরী দেবীর তৃতীয় সন্তান বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল ১৮৩৮ সালের ২৬শে জুন বাংলা ১২৪৫, ১৩ই আষাঢ় নৈহাটির কাঁটালপাড়ার এই বাড়িতে। বাড়ি, অন্দরমহল,দুর্গা দালান,বৈঠকখানা,পারিবারিক মন্দির সব নিয়ে ছিল চট্টোপাধ্যায়ের ভবন। সরকারের উদ্যোগে বাড়িটি মূল কাঠামো হুবহু এক রেখে সংস্কার করে গড়ে তোলা হয় বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্র। বর্তমানে এখানে আছে গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা।
ঋণ-
১. কমলাকান্তর দপ্তর , বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড
২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পারিবারিক দুর্গাপূজা, গৌতম সরকার
৩. অন্য এক বঙ্কিমচন্দ্র—গোপালচন্দ্র রায়
৪. বঙ্কিমচন্দ্র-জীবন ও সাহিত্য--গোপালচন্দ্র রায়
৫. বঙ্কিম-জীবনী—শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়