তখন তিনি ক্লাস টেনের পড়ুয়া। সামনেই দুর্গাপুজো (Durga Puja)। হঠাত্ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন বাবা। অথচ সামনেই পুজো। কুমোরটুলির (Kolkata Kumortuli ) বিখ্যাত শিল্পীর দুর্গাপ্রতিমায় চোখ আঁকবেন কে? লোক পাওয়া যায় না .... যায় না ... এমন মুহূর্তে পরিবারের বড়রাই তুলি ধরিয়ে দিলেন ১৫ বছরের মেয়ের হাতে। আগেও আসতেন ওয়ার্কশপে। বাবার চোখের সামনে গড়তেন ছোট ছোট মূর্তি, ঠাকুরের বাহন। কিন্তু মা দুর্গার চোখ আঁকবেন ভাবেননি কখনও। কিন্তু পরিস্থিতিতে পড়ে মই বেয়ে তরতর করে উঠলেন তিনি। হাত শক্ত করে আঁকলেন সাবেকি মূর্তিতে ত্রিনয়ন। সেই প্রথম মায়ের মূর্তিতে চক্ষুদান করলেন কুমোরটুলির কন্যা সুস্মিতা রুদ্র পাল (Susmita Rudra Paul)। অধুনা তিনি সুস্মিতা রুদ্র পাল মিত্র। মাঝ তিরিশে এসে সাবেকি মূর্তি থেকে থিমের প্রতিমা সবেতেই অনায়াস তাঁর তুলির চলন। কলকাতার কুমোরটুলির গুটিকয় মহিলা শিল্পীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এবিপি লাইভের সামনে বললেন তাঁর শিল্পী-জীবনের গল্প।
তিনি মোহনবাঁশী রুদ্র পালের পরিবারের কন্যা। সম্পর্কে তাঁর নাতনি। প্রতিমাশিল্প তাঁর রক্তে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই শিল্পসত্ত্বার প্রকাশ ঘটত ছোট থেকেই। বাবাকে দেখে ওয়ার্কশপে ছোট ছোট মূর্তি গড়তেন সুস্মিতা। কখনও বাহন, কখনও ছোট্ট ছোট্ট পুতুল। কিন্তু মা দুর্গার মূর্তির দায়িত্বে ছিলেন পরিবারের পুরুষ শিল্পীরাই। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটার সামনে হঠাতই একদিন এসে পড়ল বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ । অনেকটা অগ্নিপরীক্ষার মতো। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার বছরই সুস্মিতার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পুজোর আগে পরিস্থিতি সামাল দিতে , কাকারা বললেন, 'সামনেই তো প্রতিমার ডেলিভারি, তুই-ই তুলি ধর। ' সেই প্রথম। আর প্রথম পরীক্ষাতেই সফল তিনি। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে সুস্মিতা রুদ্র পাল হয়ে ওঠেন কুমোরটুলির নিয়মিত শিল্পী।
এরপর বিয়ে, সংসার, সন্তান। তবু ছেদ পড়েনি সুস্মিতার কাজে। শ্বশুরবাড়িতে সারা বছর গয়না তৈরি, ব্লাউজে আঁকার কাজ করেন । আর প্রতিমা তৈরির সময়ে বালি থেকে চলে আসেন আহিরীটোলায় পটুয়াপাড়ায়।
সুস্মিতা জানালেন, মহিলা হওয়ার জন্য অনেক বাধার সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়নি। কিন্তু ঠাকুর গড়ার কাজ বেশ কঠিন। বিশেষত বড় ঠাকুর গড়া। তাই হয়ত মহিলারা এই দায়িত্ব নিতে ভয় পান। তাছাড়া পরিশ্রম, অর্থনৈতিক অবস্থা, ইত্যাদি নানা কারণে, মহিলাদের এখনও এই পেশায় খুব একটা দেখা যায় না। তবু কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। কাজ জানি যখন, করব না কেন? দৃঢ় গলায় প্রশ্ন সুস্মিতার। তাঁর আশা, আগামী দিনে নারী-পুরুষ সমানে-সমানে কাজ করবে কুমোরটুলিতে।