কমলকৃষ্ণ দে, পূর্ব বর্ধমান: মাঝে পেরিয়েছে ২৫ বছর। বইপত্তর তো দূর, পড়াশুনোর (Education) সঙ্গে বিন্দুমাত্র সম্পর্কও ছিল না। কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে হার মানলেন মা। ফের বই খুলে যেমন পড়তে বসলেন, তেমনই এবছর দিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষাও (Madhyamik Exam)। ছেলের সঙ্গে একসঙ্গে দিলেন পরীক্ষা। 



চলতি মাধ্যমিক পরীক্ষায় মা ও ছেলে একসঙ্গে মাদ্রাসার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলেন। এই খবরে রীতিমত কৌতূহল সৃষ্টি হল মেমারিতে। বর্ধমান (Burdwan) ২নং ব্লকের ঘাটশিলার বাসিন্দা আয়েশা বেগম এবং তাঁর ছেলে শেখ পারভেজ আলম একইসঙ্গে দিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষা। নয় নয় করেও প্রায় ২৫ বছর পর আয়েশা বেগম বসলেন পরীক্ষায়। আর অর্থনৈতিক কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেবার পর প্রায় ৬ বছর পর ফের মায়ের সঙ্গে পরীক্ষায় বসলেন ছেলে। 



আয়েশা বেগম জানিয়েছেন, ঘাটশিলা সিনিয়ার সিদ্দিকা মাদ্রাসার ছাত্রী হিসাবে তিনি এবার মাধ্যমিক দিচ্ছেন। আয়েশা বলেন, 'মেয়ে ফিরদৌসী খাতুন আগেই পড়াশুনো হয়েছে। ছেলেও পড়েছে। মেয়েকে কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  এম.এ করিয়েছি। বর্তমানে বি.এডের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।' যদিও মা সেখানে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। তার জন্য মেয়ের ইচ্ছেতেই ফের পড়াশুনা শুরু করেছেন তিনি। আয়েশা বলেন, 'মেয়ের উৎসাহেই আমি এই জায়গায় এসেছি। ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছি। অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পর ৩ মাস ক্লাস করার সুযোগ জুটেছিল। তারপর থেকে আর স্কুলে যাইনি। তারপর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর সংসার সামলানো। পড়াশোনা আর করতে না পারার আক্ষেপ ছিলই। যখন দেখি সবাই পড়াশোনা করছে। স্কুলে যাচ্ছে। কলকাতার আলিয়া থেকে মেয়ে এম এ করেছে। ওখানে এবং অন্যান্য জায়গায় মেয়েকে নিয়ে যেতে হয়। খারাপ লাগে আমি যদি আর একটু শিখতে পারতাম তাহলে মেয়ের সাথে আরও অনেক জায়গায় যেতে পারতাম।'


আয়েশা বেগম জানিয়েছেন, সংসারের সব কাজ করে যেটুকু সময় পেয়েছেন সেই সময়ে পড়াশোনা করেছেন। অনেকে অনেক কথা বলছে আবার অনেকেই বলছে আমি যেরকম পেরেছিস, তেমন আমরা পারছি না। আমার দেখে আরও অনেকে আসুক এই জায়গায়, শিক্ষিত হোক -এটাই আমি চাই। অনেকে পিছিয়ে আছে। তারাও নিজেদের সাহসে এগিয়ে আসুক। তিনি বলেন, পাড়ায় অনেকে অনেক কিছু বলবে, আমাকেও বলছে। আমি কারও কথা শুনিনি। নিজের অধিকারটা নিজে বুঝে নিতে চাই। আমি দারুণ খুশি মা-ছেলে একসঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছি। 


আরও পড়ুন, বাড়িতে অ্যাডমিট ভুলে অঝোরে কান্না, রাস্তায় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মুশকিল আসান 'পুলিশ কাকু'


তিনি জানিয়েছেন, ২০১০ সাল থেকে শক্তিগড় থানার অন্তর্গত বর্ধমান ২নং সুসংহত শিশুবিকাশ সেবা প্রকল্পের অধীন ২০ নং কেন্দ্রের আই সি ডি এস সহায়িকা কর্মী হিসাবে কাজ করছেন তিনি। মাধ্যমিকেই শেষ নন। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকও দিতে চান তিনি।


আয়েশা বেগমের ছেলে শেখ পারভেজ আলম জানিয়েছেন, ঘাটশিলা সিদ্দিকা সিনিয়ার মাদ্রাসার ছাত্র হিসাবে তিনি পরীক্ষা দিচ্ছেন মায়ের সঙ্গেই। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুম্বইয়ে জুয়েলারীর কাজ করতে বাইরে চলে গেছিলেন। ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল। কিন্তু আর্থিক কারণে কাজ করতে হয়। তিনি জানিয়েছেন, মায়ের সঙ্গে একসঙ্গেই প্রস্তুতি নিয়েছেন পরীক্ষার জন্য।


অন্যদিকে, মেমারি হাইমাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, ঘাটশিলা সিনিয়ার হাই মাদ্রাসার দুজন পরীক্ষার্থী মা এবং ছেলে একই সঙ্গে মাধ্যমিক দিচ্ছে। এটা বলতে খুব ভাল লাগছে। মায়ের শিক্ষার প্রতি টান, মাধ্যমিক পাশের জেদ। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার আকুতিকে স্যালুট জানানোর মত বিষয়। আগামী প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত। আমরা শিক্ষকরাও উৎসাহিত হয়েছি এই ঘটনায়।