সুনীত হালদার, হাওড়া: বদ্ধ ঘরে থেকে বিশ্বদর্শনের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। বরং ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়াতেই ছিল অমোঘ আকর্ষণ। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি যদিও সেই স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু জগৎ না হলেও, ভূ-ভারত চাক্ষুষ করার স্বপ্ন থেকে একচুল টলেননি বঙ্গতনয়। তাই মাত্র ২৫০০ টাকাকে পুঁজি করেই বেরিয়ে পড়েছিলেন। ভরসা ছিল দু’পেয়ে সাইকেলটি। আর তাতেই নজির গড়লেন।


ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়াতেই ছিল অমোঘ আকর্ষণ


হাওড়ার  (Howrah News) উলুবেড়িয়ার শ্যামপুরের কাঁঠালদহ গ্রামের ছেলে অনিমেষ মাজি। ছোট থেকে দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাবার চানা-মুড়ির দোকান থেকে যা আয় হতো, তাতে বিশ্বদর্শন যে সম্ভব নয়, তা বুঝে গিয়েছিলেন। কিন্তু আশা ছাড়েননি ওই তরুণ। কোনও রকমে ২৫০০ টাকা এবং সাইকেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। স্বপ্নপূরণ হলে জয়ের মুহূর্ত বাঁধিয়ে রাখতে নিয়েছিলেন একটি তেরঙ্গাও। বলা বাহুল্য তা ওড়াতে সক্ষম হলেন তিনি (Howrah Man Touring India)।


পকেটের জোর থাকলে ভারত তো বটেই, বিশ্বদর্শনও মুড়ি-মুড়কি। কিন্তু ওই জায়গাটিতে দুর্বল ছিলেন অনিমেষ। তাই ভূ-ভারতকে দেখতে দেড় বছর সময় লেগে গিয়েছে তাঁর। এই দেড় বছর সাইকেলের প্যাডেলে পা চালিয়ে ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। শেষ মেশ, বৃহস্পতিবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলেন।


এ দিন পাড়ায় পা রাখতেই, অনিমেষকে ছেঁকে ধরেন সকলে। শ্যামপুর মোড়েই বিভিন্ন ক্লাব এবং সংগঠবনের তরফে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁকে। তাতে আপ্লুত হয়ে পড়েন সাধারণ, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিমেষ। ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্ন যে কোনও দিন ছুঁয়ে দেখতে পারবেন, এখনও অবিশ্বাস্য ঠেকছে তাঁর।


আরও পড়ুন: Madhyamik 2023: অরিজিনাল অ্যাডমিট কার্ড ও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক, কড়া নজরদারিতে আজ শুরু মাধ্যমিক


২০২১ সালের ৭ অক্টোবর সাইকেল নিয়ে পাড়ি দেন অনিমেষ। ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ু, পুদুচ্চেরী, কেরল, কর্নাটক, গোয়া,মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, পঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, হিমাচলপ্রদেশ-সহ একে একে সব রাজ্য ছুঁয়ে দেখেছেন। বাড়ি ফিরে এলেও এখনও উত্তেজনা চাপতে পারছেন না অনিমেষ। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “আমাদের দেশ কত সুন্দর, সকলের কাছে তা তুলে ধরাই উদ্দেশ্য আমার। এই দেড় বছরে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানে যেমন গিয়েছি, তেমনই প্রত্যন্ত গ্রামেও গিয়েছি। সেখানকার মানুষের সঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি, গল্প হয়েছে। পরিচিত হয়েছি তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে।”নতুন ভাষাও শিখেছেন কিছুটা।


কিন্তু মাত্র ২৫০০ টাকার ভরসায় বাইরে বেরনো অনিমেষকে কম কষ্টও সইতে হয়নি। জলে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-বরফে, খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়েছে তাঁকে। হাতে টাকা রাখতে কখনও রাস্তা তৈরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন, কখনও আবার হোটেলে বাসনও মেজেছেন। কিন্তু নিজের দেশকে চেনা-জানার আগ্রহ থেকে কখনও সরেননি। তাতে যা দেখেছেন, চোখ জুড়িয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন অনিমেষ। তিনি জানিয়েছেন, জীবন একটাই। আর একটি পাওয়া যাবে না। তাই আশা-স্বপ্ন যা রয়েছে, পূরণ করে ফেলা উচিত।


মাত্র ২৫০০ টাকার ভরসায় বাইরে বেরনো অনিমেষকে কম কষ্টও সইতে হয়নি


তবে অনিমেষ স্বপ্নপূরণের খুশিতে এখনও বিভোর থাকলেও, ছেলে বাড়ি ফিরেছে, তাতেই স্বস্তিতে তাঁর পরিবার।  বাড়িতে মা-বাবা ছাড়াও এক বোন রয়েছে তাঁর। বাবা সিনেমা হলের উল্টো দিকে দোকান চালান। চানা মশলা, মুড়ি, চা বিক্রি করেন পথচলতি মানুষকে।  ভারতদর্শনে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দোকানে বাবাকে কাজে সাহায্য করতেন অনিমেষও।  কিন্তু ছেলেকে স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত করেননি মা-বাবাও।