সুনীত হালদার, সাঁতরাগাছি: আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল ঢের আগেই। এবার কি তা সত্য প্রমাণিত হল? পরিযায়ী পাখিরা কি সত্যিই সাঁতরাগাছি ঝিল বিমুখ হয়ে পড়ছে? প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন পক্ষীপ্রেমীরা। প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কারণ চলতি শীতের মরশুমে সাঁতরাগাছি ঝিলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনই বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আনাগোনাও কমে গিয়েছে যথেষ্ট। সেই নিয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন পক্ষীপ্রেমিকরা। (Howrah News)


প্রতি বছর শীতকালে সাঁতরাগাছি স্টেশন লাগোয়া ঝিল হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি ভিড় করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই হয় হিমালয়ের প্রাচীর টপকে উড়ে আসে, কেউ অনেকে আবার উড়ে আসে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশ থেকে। এই পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে হুইসলিং ডাক, গাডোয়াল, ফেরুজিনাস পোচার্ড, নর্দার্ন পিনটেল, কমন টিল, গার্গানি প্রজাতির হাঁসও থাকে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাঁতরাগাছি ঝিলে এসে আশ্রয় নেয় তারা। দিনভর কচুরিপানায় ঢাকা ঝিলের জলে খেলে বেড়ায় তারা। (Santragachhi News)


বছরের এই সময়ে সাঁতরাগাছি ঝিল এলাকা তাই দেশ-বিদেশ থেকে উড়ে আসা পাখিদের কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে। আকাশপানে তাকালেও ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের উড়তে দেখা যায়। সাঁতরাগাছির ঝিলে পাখি দেখতে তাই ভিড় করেন বহু মানুষই। বহু দূর থেকে ছুটে আসেন পক্ষীপ্রেমীরা। শীতের মরশুমে ক্যামেরা, বায়নোকুলার, মোবাইল ফোন নিয়ে দৌড়ে বেড়াতে দেখা যায় তাঁদের। কেউ তাকিয়ে শুধু দেখেন, কেউ আবার ক্যামেরাবন্দি করেন পাখিদের। 


আরও পড়ুন: East Burdwan: ফায়ার অফিসারের ভুয়ো পরিচয় দিয়ে জুলুম, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বিক্রির অভিযোগ! গ্রেফতার ৩


কিন্তু এবছর পাখির সংখ্যা বেশ কমে গিয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছে পক্ষীপ্রেমী সংস্থা প্রকৃতি সংসদও। ঝিলে পাখি গোনার কাজ সম্প্রতি শেষ করেছে ওই সংস্থা। আর তাতেই বিপদবার্তা মিলেছে। জানা গিয়েছে, এবছর সাঁতরাগাছি ঝিলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা মাত্র ৪ হাজার ৮১৪। হাতেগোনা ১৪ প্রজাতির পাখিই এসে হাজির হয়েছে। ট্রান্স হিমালয়ান বার্ড অর্থাৎ মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া এবং উত্তর চিন থেকে উড়ে আসা পাখির সংখ্যা নামমাত্র।


অথচ এক বছর আগেও পাখির সংখ্যা ছিল বেশি। গত বছর সাঁতরাগাছি ঝিলে ১৪টি প্রজাতির ৬ হাজার ৭৪২ পরিযায়ী পাখি এসে হাজির হয়। তার আগের বছর পাখির সংঁখ্যা ছিল ৫ হাজার ৬৫১। আর যদি একদশক আগের কথা ধরা হয়, তাহলে ২০টি প্রজাতির ৭ হাজারের বেশি পাখি আসার নজিরও রয়েছে। তাই এবছর পরিযায়ী পাখির সংখ্যা এত কমে গেল কেন প্রশ্ন উঠছে। 


এর উত্তর দিতে গিয়ে প্রকৃতি সংসদ জানিয়েছে, এবছরে শীতের আগমন ঘটেছে অনেক দেরিতে। প্রতি বছর নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পাখির আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। এবছর পাখি আসতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হয়ে গিয়েছে। জানুয়ারি মাসে শীত পড়লে পাখির সংখ্যা বাড়ে প্রতিবছর। কিন্তু এবছর মোট পাখির সংখ্যাই কম। বিশেষজ্ঞদের মতে, চারিদিকে বড় বড় নির্মাণ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তার জেরে ঝিলে আসতে বাধা পাচ্ছে পরিযায়ী পাখিরা। এর পাশাপাশি নিকাশিনালার জল ঝিলে এসে মেশায় জলে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। জলে নিউট্রিয়েন্ট মেশায় দ্রুত ছড়াচ্ছে কচুরিপানা। প্রতি বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঝিল পরিষ্কারের কাজ শেষ হয়ে যায়। কচুরিপানা দিয়ে ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি করা হয়, যাতে পাখিরা বসতে পারে। বাকি অংশে শুধু জল থাকে, যাতে সেখানে খেলতে পারে তারা।  কিন্তু এ বছর সেভাবে ঝিল পরিষ্কার করা হয়নি, তাতেই সমস্যা বেড়েছে।


জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকারের বায়োডায়ভার্সিটি বোর্ড এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দিয়ে ঝিল পরিষ্কার করাতো।  কিন্তু তাদের বকেয়া টাকা না মেটানোয়, এ বছর ঝিল সেভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।  এর ফলেও মুখ ফিরিয়ে  নিয়েছে পরিযায়ী পাখিরা। প্রকৃতি সংসদের সদস্য এবং প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক প্রসেনজিৎ দাঁ  জানিয়েছেন, যেখান থেকে পাখিরা আসছে, সেখানকার জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যাভাব এবং পাখিশিকার এই কমে যাওয়ার কারণও হতে পারে। পাশাপাশি তিনি সতর্ক করেছেন, সাঁতরাগাছি ঝিল নিয়ে এখনই যদি কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে পরিযায়ী পাখিদের আসাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে।