নয়াদিল্লি:  টিনের কৌটোর মুখে যেমন পাতলা আস্তরণ থাকে, খোসা ছাড়ানোর মতো একপাশ থেকে টেনে তুলতে হয়, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে মাটির স্তরও সেভাবেই উঠে আসছে ক্রমশ। মাটির নিচে থাকা ভারতী মহাদেশীয় টেকটোনিক পাতে ফাটল ধরার ফলেই এমন ঘটছে বলে উঠে এল গবেষণায়। বলা হয়েছে, ভারতীয় টেকটোনিক পাত দু'টুকরো হচ্ছে ক্রমশ। তাতেই হিমালয় পর্বতের উচ্চতা বেড়ে চলেছে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে আগামী দিনে তিব্বত  দু'টুকরো হয়ে যেতে পারে বলে দাবি ভূবিবিজ্ঞানীদের। (Tectonic Collision in the Himalayas)


আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্র তুলে ধরা হয়। তাতেই পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালার নিচে, ভূগর্ভে মারাত্মক ওঠাপড়া চলছে বলে দাবি করা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, মাটির নিচে যা ঘটছে, তা অত্যন্ত জটিল। দুই মহাদেশীয় পাত, ইন্ডিয়ান এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। তার ফলে খোসা ছাড়ানোর মতো মাটির স্তর উপরের দিকে উঠে আসছে, যার ফলে হিমালয় পর্বতমালার উচ্চতা বেড়ে চলেছে লাগাতার। (Indian Tectonic Plate)


বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মহাসাগরীয় এবং মহাদেশীয় পাতের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে, যে পাতের ঘনত্ব বেশি, সেটি হালকা পাতের নিচে ঢুকে যায়, যাকে অবনমন বলা হয়। কিন্তু যদি দুই পাতের ঘনত্ব সমান হয়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কোন পাত বসে যাবে, কোনটি উপরে উঠে আসবে, নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হয় না। হিমালয়ের নিচে, ভূগর্ভের অভ্যন্তরেও ঠিক তেমনই পরিস্থিতি এই মুহূর্তে। ফলে তিব্বতের ভবিষ্যতের উপর খাঁড়া ঝুলছে।


আরও পড়ুন: Crippled Peregrine Lunar Lander: মাঝ আকাশেই পঙ্গু বিদেশি চন্দ্রযান, ফিরতে হচ্ছে চাঁদের দোরগোড়া থেকে, পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা


কেউ কেউ মনে করছেন, ঘনত্বের নিরিখে ভারতীয় টেকটোনিক পাতটি ইউরেশীয় টেকটোনিক পাতের তুলনায় এগিয়ে।  এক্ষেত্রে পুরোপুরি অবনমন না ঘটে, ইউরেশীয় পাতের নিচে ঢুকে যেতে পারে ভারতীয় টেকটোনিক পাতটি, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে Underplating বলা হয়। বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, ভারতীয় টেকটোনিক পাতটির তুলনামূলক নিচু জায়গাগুলি মাটিতে বসে যাচ্ছে। উপরের অংশ তিব্বতের ভার সহ্য করেও টিকে রয়েছে। তার ফলেই মাটির স্তর ফুলে উঠছে, যা থেকে উচ্চতা বাড়ছে হিমালয়ের। 


বর্তমানে, দু'টির মধ্যে যে কোনও একটি ঘটছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। ভারতীয় পাতটি মাটির নিচে বসে যাচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে পাতটি ক্রমশ মুচড়ে এবং মাঝ বরাবর ফাটলও ধরছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পাতের উপরিভাগের অর্ধেক অংশ খোসার মত উঠে আসছে। নেদারল্যান্ডসের Utrecht University-র জিওডায়নামিসিস্ট ডুয়ে ভ্যান হিন্সবার্গেন বলেন, "মহাদেশ যে এমন আচরণ করতে পারে, ধারণা ছিল না আমাদের।"


বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, হিমালয় পার্বত্যঅঞ্চলে ভূমিকম্পের তরঙ্গের গতিপথ খতিয়ে দেখে বিষয়টি নজরে এসেছে তাঁদের। বলা হয়েছে, দুই পাতের সংযোগস্থল থেকে কম্পনের তরঙ্গ উঠে আসছে। ভারত মহাদেশীয় পাতের উপরের অংশে চিড় ধরেছে বলে ধরা পড়েছে গবেষণায়। কিছু জায়গায়, ভারত মহাদেশীয় পাতের নিচের অংশ প্রায় ২০০ কিলোমিটার গভীর। কিছু জায়গায় আবার গভীরতা মাত্র ১০০ কিলোমিটার। তাই উঁচু অংশটি আসল অবস্থান থেকে উপরের দিকে উঠে এসেছে বলে মত বিজ্ঞানীদের।


এর আগে, ২০২২ সালে Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America-এ প্রকাশিত জার্নালে বলা হয়, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত উষ্ণ প্রস্রবণগুলি থেকে বুদবুদের আকারে হিলিয়াম উঠে আসছে। হিলিয়ামের রূপান্তরিত অবস্থা, হিলিয়াম-৩ ধরা পড়ে পরীক্ষায়। মাটির গভীর থেকেই সেটি উঠে আসে বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু হলে, হিমালয়ের উত্তরে দুই পাতের সংযোগস্থল নির্ধারণে সাফল্য পান বিজ্ঞানীরা। দুই পাতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি  বেড়ে গিয়েছে বলেও উঠে এসেছে নয়া গবেষণায়। আগামী দিনে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে  এই নয়া গবেষণা।