জলপাইগুড়ি: ওড়িশার কালাহান্ডিতে স্ত্রীর দেহ তুলে নিয়ে যেতে হয়েছিল ডানা মাঝিকে। মর্মান্তিক সেই দৃশ্য দেখে শিউড়ে উঠেছিল গোটা দেশ। এ বার বাংলার জলসপাইগুড়িতে তার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সেখানে মায়ের মৃতদেহ কাঁধে তুলে হাঁটতে হল ছেলেকে। অথচ পাশেই সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল অ্যাম্বুল্যান্স। বৃহস্পতিবার বারবেলায় কার্যতই লজ্জায় মুখ ঢাকল বাংলা।
এই ঘটনায় সরাসরি রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি বাংলার স্বাস্থ্যমন্ত্রীও, তাঁর দিকে আঙুল তুলছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ২০০ শতাংশ কাজ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন, সেখানে এমন ঘটনা গ্রাম বাংলার দুর্দশার ছবিই প্রকট ভাবে তুলে ধরছে।
এ দিনের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সরাসরি মমতার দিকেই আঙুল তোলেন সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী। এবিপি আনন্দে তিনি বলেন, "জলপাইগুড়ি থেকে যে ছবি উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জলপাইগুড়ি প্রায় কালাহান্ডি হয়ে গেল। ৩ হাজার টাকা দিতে পারেনি, অতএব শব কাঁধে ছেলে চলেছে ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরের বাড়ির উদ্দেশে! কোথায় প্রশাসন, কোথায় কী! টাকা দিতে পারেনি বলে মায়ের দেহ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হবে বাংলায়! কালাহান্ডি দুর্ভিক্ষের জায়গা। ডানা মাঝি নাম ছিল সেই ব্যক্তির। তাতে শিউড়ে উঠেছিল গোটা দেশ। এত মর্মান্তিক চেহারা আমাদের জলপাইগুড়ির!"
সুজন আরও বলেন, "মুখ্যমন্ত্রীর তো বলছিলেন যে, সব ব্যস্থা রয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। টাকা দিতে পারল না বলে কোনও ব্যবস্থা থাকবে না! সরকারি হাসপাতালের কী মর্মান্তিক, বীভৎস চেহারা! বাংলার গ্রামের পরিস্থিতি প্রকট হয়ে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় কোনও উৎসবে রয়েছেন। টের পাবেন কিনা জানি না। উনি কিনা স্বাস্থ্য মন্ত্রী! ভাবা যায় না। রোজ সরকার যে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে, 'জন্ম-মৃত্যু সব করে দিলাম', তার পর এমন দৃশ্য মানা যায় না। বয়াবহ পরিস্থিতি বাংলার।"
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীও রাজ্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্নীতিতে ক্ষরে গিয়েছে বলে দাবি তাঁর। অধীরের কথায়, "সব হাসপাতালে এই কারচুপি রয়েছে। রক্ত নিয়ে, অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া নিয়ে, ওষুধ নিয়ে দুর্নীতি চলছে দেদার। যে ওষুধ হাসপাতালে সরবরাহ করা হয়, তাতে কাজ হয় না। হাসপাতালের দেওয়া ওষুধে রোগ সারে না, কিন্তু ব্র্যান্ডেড ওষুধ খেলে সেরে যায় রোগ। এই চলছে। লুঠতরাজ চসছে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে।"
বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের বাইরে মায়ের দেহ কাঁধে ছেলেকে দেখা যায়। মৃতার ছেলে জানিয়েছেন, শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয় মায়ের। তাতে বুধবার রাতে জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করেন তিনি। কিন্তু বাঁচানো যায়নি মাকে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় মারা যান তাঁর মা। মায়ের দেহ নিয়ে যেতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান তিনি। কিন্তু লাভ হয়নি।
এর পর হাসপাতালের বাইরে যে অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা রয়েছে, টাকার বিনিময়ে সেখান থেকে গাড়ি পাওয়া যায়। কিন্তু যোগাযোগ করলে ৩ হাজার টাকা চাওয়া হয় তাঁর কাছে, যা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তাঁর। উপায় না দেখে তাই মায়ের দেহ কাঁধে তুলেই রওনা দেন তিনি। নগরডাঙা এলাকায় বাড়ির পথে রওনা দেন ওই ব্যক্তি। মাঝে কাঁধ থেকে দেহ নামিয়ে মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতেও দেখা যায় তাঁকে।
হাসপাতালের বাইরে এমন দৃশ্য চাউর হতে সময় লাগেনি। বিষয়টি কানে পৌঁছয় এলাকার একটি সমাজসেবা সংগঠনের। ওই সংস্থার তরফেই পরে ওই ব্যক্তিকে গাড়ির ব্য়বস্থা করে দেওয়া হয়। হাসপাতালের সুপার জানিয়েছেন, মৃতার ছেলের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। ৩ হাজার টাকা চাওয়া হয় বলে জানতে পেরেছেন তিনি।
কিন্তু গতকাল রাতে ৯০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির পরও ন্যূনতম সহযোগিতা মিলল না কেন, প্রশ্ন উঠছে। হাসপাতালের সুপার জানিয়েছেন, যাঁরা এই কাজ করেছেন, অত্যন্ত অমানবিক কাজ করেছেন। হাসপাতালের কর্মী এবং নিরাপত্তারক্ষীদের নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। কেন ওই ব্যক্তি গাড়ি পেলেন না, জবাবদিহি করেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, সকলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।