ঝাড়গ্রাম : জেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ২০১৭ সালে, আগে ছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের মহকুমা। মাওবাদী নাশকতার শক্ত ঘাঁটি হিসেবে ঝাড়গ্রাম একাধিকবার উঠে এসেছে খবরের শিরোনামে। উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং প্রশাসনিক সুবিধার্থে এই অঞ্চলটি পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে বিভক্ত হয়ে বাংলার বাইশতম জেলা হিসেবে পরিচয় পায়। ঝাড়গ্রাম শহরটি ছোটনাগপুর মালভূমির একটি অংশ। সুদীর্ঘকাল ধরে বহিরাগতদের শাসন বজায় থাকলেও, জঙ্গলমহলের আদি বাসিন্দারা তাঁদের জীবনধারা ও সংস্কৃতির মৌলিকতা সযত্নে ধরে রেখেছেন। রাজনীতি তো বটেই, ইতিহাসের আঙ্গিকেও ঝাড়গ্রাম এ রাজ্যের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
ইতিহাস : ইতিহাস অনুযায়ী, সম্রাট আকবর, আম্বেরের রাজা মান সিংহকে দায়িত্ব দেন, বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করার। রাজা মান সিংহ জঙ্গলখণ্ড নামে পরিচিত স্থানীয় উপজাতি শাসকদের পরাজিত করতে পাঠান তাঁর সেনাবাহিনীর দুই অনুগত কর্মকর্তা সর্বেশ্বর সিং ও তাঁর বড় ভাইকে। সর্বেশ্বর সিং ও তাঁর রাজপুত সেনা মিলে পরাস্ত করেন সেখানকার শাসককে। এই বিজয় অর্জনের জন্য প্রতি বছর মলা রাজার একটি মূর্তি তৈরি করে বিজয়া দশমীতে হত্যা করা হয়।
বাংলা জয়ের পর রাজা মান সিংহ হয়ে যান বাংলার দিওয়ান আর সর্বেশ্বর সিংহকে ঝাড়গ্রামের এক বিশাল অংশ উপহার দেন। সর্বেশ্বর সিংহ এই ঝাড়িখণ্ডর সূচনা করেন আর তাঁর রাজধানীর নাম দেন ঝাড়গ্রাম যার অর্থ অরণ্যে ভরা গ্রাম ।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ঝাড়গ্রাম রাজ পরিবার ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাঁদের স্বাধীন অবস্থান রক্ষা করার জন্য “চৌর মুটিনি” তে অংশ নেয়। রাজা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজ্যে আত্মসমর্পণ করতে হয় তাঁকে। রাজস্ব প্রতি বছর মাত্র ৫০০/ -র জন্য নির্ধারিত হয়। তখন ঝাড়গ্রাম ব্রিটিশদের অধীনে জমিদারি এস্টেট হিসাবে স্বীকৃত হয় এবং শাসককে রাজা উপাধি দেওয়া হয়।
অবস্থান :
ঝাড়গ্রাম ২২.৪৫ ডিগ্রি উত্তর, ৮৬.৯৮ ডিগ্রি পূর্বে অবস্থিত। এই জেলা গড় উচ্চতায় ৮১ মিটার (২৬৫ফুট)। ঝাড়গ্রামের উত্তরে রয়েছে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলা, দক্ষিণে ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ, পূর্বে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর। এই জেলার পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড রাজ্য। এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত আর্দ্র এবং উষ্ণ। মে এবং জুনে তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছয়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারির শীতের রাতে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নামে তাপমাত্রা।
ভূ-পরিচয় :
ঝাড়গ্রাম জেলার উত্তরে কাঁকরাঝোড় ও দক্ষিণে সুবর্ণরেখা নদী। এই এলাকাটি অনুর্বরভাবে শক্ত ল্যাটেরাইট মাটি/পাথরে আবৃত। এই জেলা দিয়ে বয়ে চলেছে ডুলুং নদীও। ছোটনাগপুর মালভূমি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে সমভূমির সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় ল্যাটেরাইট শিলা /মাটির সাথে একটি ক্ষেত্র তৈরি করে। এই সমগ্র এলাকাটি বিশেষভাবে খরা প্রবণ।
অর্থনীতি :
এই জেলার অধিকাংশ মানুষ চাষাবাদের উপর নির্ভরশীল । অনুকূল পরিবেশে কৃষিকাজও বেশ ভালো হয়। ধান, গম, আলু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের ফল-শাক-সবজি উৎপাদিত হয়। ব্যবসাও ঝাড়গ্রামের অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়াও, কিছু মানুষ সরকারি কর্মচারী, স্কুল শিক্ষক এবং অন্যান্য বেসরকারি খাতে নিযুক্ত। এখানে রয়েছে অনেক টেক্সটাইল ও কৃষিভিত্তিক শিল্পও। ঝাড়গ্রামের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রয়েছে পর্যটনেরও।
রাজনীতি :
২০১৭ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাকে ভেঙে ঝাড়গ্রাম নামে এক নতুন জেলা গঠিত হয়। এর আগেও একাধিকবার খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে এই জেলা। মাওবাদী কার্যকলাপের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে ঝাড়গ্রাম খবরে ছিল।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি জঙ্গলমহলে ঘাঁটি গেড়ে বসে। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া- চারটি আসনে জয়ী হয় বিজেপি। ২০২১-এর নির্বাচনে বিজেপির সুখময় সতপথিকে হারিয়ে জয়ী হন তৃণমূলের বীরবাহা হাঁসদা।
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রটি রাজ্যের ৪২ টি লোকসভা কেন্দ্রের একটি। এটি তফশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত এবং মোট সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। মহিলা থানা নিয়ে এই জেলায় মোট ১০ টি থানা রয়েছে।
শিল্প – সংস্কৃতি :
ঝাড়গ্রাম উপজাতীয় নৃত্যের স্বর্ণ কোষাগার। এখানকার ছৌ, বাহা, ঝুমুর, টুসু নাচ নামকরা। এই জেলায় প্রচুর মেলাও হয়। জঙ্গলমহল উৎসব, ঝাড়গ্রাম মেলা ও যুব উৎসব, শ্রাবণী মেলা, বৈশাখী মেলা, মিলন মেলা তাদের মধ্যে অন্যতম।
এই জেলায় বসবাসকারী আদিবাসীদের শৈল্পিক দক্ষতা বাইরের মানুষদের কাছে প্রশংসার উদ্রেক করেছে। কাঠ, উল, বাঁশ, জুট ইত্যাদি দিয়ে তৈরি নানা জিনিস। গহনা, ব্যাগ, শাড়ি, আপনার মনের মতো ঘর সাজানোর জিনিসও মিলবে এখানে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা :
ঝাড়গ্রাম জেলায় পরিবহন ব্যাবস্থা হিসেবে উন্নত সড়কপথ তো রয়েছেই, সঙ্গে রেলপথও রয়েছে।
রেলপথে- কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব ১৫৪ কিমি। হাওড়া/টাটানগর থেকে এক্সপ্রেস/লোকাল ট্রেনে ঝাড়গ্রাম যাওয়া যায়। একটি ট্রেন কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম পৌঁছতে সর্বনিম্ন সময় নেয় ২ ঘণ্টা ২৪ মি।
সড়কপথে- কলকাতা থেকে ঝাড়গ্রামের দূরত্ব ১৭৮ কিমি। কলকাতা থেকে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরলে, চার ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন ঝাড়গ্রামে।
আকাশপথে- নিকটতম বিমানবন্দরটি ভারতের কলকাতা, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা ঝাড়গ্রাম থেকে প্রায় ১৮৮ কিলোমিটার দূরে।
পর্যটন :
ঝাড়গ্রাম জেলার অন্যতম আকর্ষণ হল বেলপাহাড়ি। এছাড়াও সুবর্ণরেখা নদী এবং কাঁকড়াঝোড়, প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য আদর্শ স্থান। শাল, টিক, পিয়াল, মহুলের জঙ্গলে দেখা মিলবে বুনো হাতি, হরিণ এবং বিভিন্ন পাখিদের। যাঁরা জঙ্গল ভালবাসেন, তাঁদের জন্য ঝাড়গ্রাম কিন্তু দারুণ পর্যটক কেন্দ্র হতে পারে। এখানে রয়েছে প্রচুর প্রাচীন মন্দির, রাজবাড়ি। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। এর পাশাপাশি সংস্কৃতির দিক থেকেও ঝাড়গ্রাম সবসময় পর্যটকদের নজর কেড়ে নেয়। ঝাড়গ্রামের লোকসঙ্গীত, সাঁওতাল নাচ- এইসবই আপনার পর্যটনে অন্য মাত্রা যোগ করবে।
ডিয়ার পার্ক, কুরুম্বেরা দুর্গ, কেন্দুয়া, হাতিবাড়ি, চিল্কিগরের কনকদুর্গা মন্দির, রামেশ্বর মন্দির, তপোবন ঝাড়গ্রামের কিছু উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র।
বর্তমান ঝাড়গ্রামে রাজার আমলের নানা ঐতিহাসিক স্মারক, মন্দির, প্রাসাদের পাশাপাশি আদিবাসী সংস্কৃতির বিভিন্ন নিদর্শন এই জেলাকে বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। ব্যতিক্রমি প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক বৈশিষ্টের জন্য ভ্রমনপিপাসু বাঙালির কাছে ঝাড়গ্রাম অন্যতম প্রিয় জায়গা ।