সুকান্ত দাস, হিন্দোল দে ও রঞ্জিত হালদার, জয়নগর: তৃণমূলের এক নেতাকে খুনের ঘটনা। তারপরেই পাল্টা হামলায় কার্যত আগুন জ্বলল জয়নগরে (Joynagar)। এক অভিযুক্তকে পিটিয়ে খুন, একটি গ্রামে ভাঙচুর, লুঠপাট, আগুন লাগানোর মতো ঘটনা ঘটল। দমকলকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠল। পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গেল বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীর বাড়ি। আর সব মিলিয়ে আতঙ্কে কার্যত কাঁটা জয়নগরের দলুয়াখাকি গ্রাম।


ঘটনা শুরু তৃণমূলের (TMC) অঞ্চল সভাপতিকে খুন দিয়ে। ওই ঘটনার পরেই অভিযুক্তদের তাড়া করে একদল গ্রামবাসী। একজনকে ধরেও ফেলেন তাঁরা। তখনই গণপ্রহারে মৃত্যু হয় ওই অভিযুক্ত ব্যক্তির। সেই সময়ের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ওই ঘটনার পরেই ৫ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে হামলা হল। অভিযোগ ওই গ্রামে সিপিএম কর্মীদের বেছে বেছে হামলা চালিয়েছে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। 


কখন কী হল:
সোমবারের এই ঘটনায় ফিরে এসেছে বীরভূমের বগটুইয়ের স্মৃতি। দীপাবলি শেষ হতেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে কার্যত তাণ্ডব চলল। ঘটনার সূত্রপাত, তৃণমূলের বামনগাছি অঞ্চলের সভাপতি ও পঞ্চায়েত সদস্য, ৪৮ বছরের সইফুদ্দিন লস্করকে খুনের ঘটনায়। যিনি আবার বামনগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানের স্বামী। স্থানীয় সূত্রে খবর, সোমবার ভোর পৌনে ৫টা নাগাদ, বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তৃণমূল নেতা। অভিযোগ, তখন ২টো মোটরবাইকে করে ৫-৬ জন দুষ্কৃতী এসে তাঁকে গুলি করে। 


নিহত তৃণমূল নেতার বাবা ইলিয়াস লস্কর বলেন, 'আমার ছেলের সঙ্গে কারও কোনও শত্রুতা করা। শুধু একমাত্র ওর কারণ হচ্ছে একটা জনসভা করা। আর কিছু নয়। মানুষের একবিন্দু কোনও কেউ বলতে পারবে না, যে কারও ক্ষতি করে গেছে। এরকম নজির ওর নেই।' বামনগাছির বাঙালবুড়ির মোড়ে তৃণমূল নেতাকে খুন করে পালানোর সময়, দুষ্কৃতীদের ধাওয়া করেন স্থানীয়রা। ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ মিটার দূরে, দক্ষিণ বারাসাত যাওয়ার রাস্তার উপর ধরা পড়ে যায় একজন। সেখানে সাহবুদ্দিন শেখ এক অভিযুক্তকে পিটিয়ে খুন করা হয়। তবে ওই ঘটনার আগে ওই ব্যক্তির বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অন্যদিকে তৃণমূল নেতা খুনে সাহারুল শেখ নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 


গোটা ঘটনা নিয়ে এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সিদ্ধিনাথ গুপ্তা বলেন, 'কয়েকটি ফোন কল পাওয়া গেছে, সিআইডি-র সাহায্য নিচ্ছি। কে করেছে বলা যাচ্ছে না, তবে আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি কিনারা হবে।'


জয়নগরের এই ঘটনায় দিনভর উত্তপ্ত ছিল রাজ্য রাজনীতি। তৃণমূলের অভিযোগ, সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা খুন করেছে তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতিকে। তারই পাল্টা জনরোষের শিকার হয়েছে তারা। তৃণমূল বিধায়ক সওকত মোল্লা বলেন, 'সিপিএম এবং বিজেপি আশ্রিত সমাজবিরোধীরা, তারা সইফুদ্দিনকে খুব কাছ থেকে গুলি করে। এর মূল উদ্দেশ্য হল এটাই যে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা জুলে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। কারণ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায়, তাদের পায়ের তলার মাটি নেই।' পাল্টা সিপিএমের দাবি, তৃণমূলে বখরার ভাগ নিয়ে বিবাদের জেরেই এই খুন হয়েছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, 'মাফিয়া নেতা বলে সবাই চেনেন, আশপাশের সবাই। বিস্তীর্ণ এলাকা মিলিয়ে তার মাফিয়ারাজ চলে। পুলিশের ডাকমাস্টার, একাই সব। ফলে বখরার লড়াই, এটা কে জানে না। বখরার কে কত পাবেন, এটা লড়াই তার। অন্য কারও ঘাড়ে দোষ চাপালে হয় না।'


তৃণমূল নেতা যেখানে খুন হন, সেখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে দলুয়াখাকি গ্রাম। ওই গ্রাম থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জয়নগর থানা। তৃণমূল নেতা খুনের পর, ৫ কিলোমিটার দূরে সেই গ্রামে সিপিএমের নেতা-কর্মীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একের পর এক। তৃণমূলের লোকজনের বিরুদ্ধে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠেছে। 


আর এই হামলায় কার্যত সব হারিয়ে পথে বসেছেন আক্রান্ত গ্রামবাসীরা। গোটা ঘটনায় তৃণমূলের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন তাঁরা। বাড়িঘর ভাঙচুর করে, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঘরের গরু-ছাগল, জিনিসপত্র লুঠ করার অভিযোগও উঠেছে। সব লুঠপাট করে পরে দেশলাই এনে ছড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বলেছে।' আগুন লাগার খবর পেয়ে এসেছিল দমকল। তাদের গ্রামে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সারাদিনের এই তাণ্ডবের পরে আতঙ্কে কাঁটা গোটা গ্রাম। প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন অনেকে। আর সোমবারের গোটা ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ-প্রশাসন নিয়েও। প্রথম ঘটনার পরেই কেন পদক্ষেপ করল না পুলিশ? চার ঘণ্টা ধরে গ্রামে তাণ্ডব চালালেও কেন পুলিশ কোনও খবর পেল না? গোটা ঘটনায় নিষ্ক্রিয়তা২র অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।


আরও পড়ুন: 'হাত ধরে গান করুন এই জেল যদি না শেষ হয়', পার্থ-জ্যোতিপ্রিয়কে কটাক্ষ সুকান্তর