কলকাতা: "নমস্কার, কেমন আছেন সবাই...'' তাঁর উষ্ণ অভ্যর্থনা ছড়িয়ে গিয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। সহজ কথায় মন জিতেছেন নেটিজেনদের। তাঁর প্রতিদিনের জীবনের মাধ্যমে ওদেশের গল্প তুলে ধরছেন সারা বিশ্বের সামনে। এক ক্লিকেই সবাই দেখতে পাচ্ছেন এই বাংলার মেয়ের বিদেশে দিন কাটানোর ছবি। তিনি মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়। ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহারকারীদের কাছে তিনি 'প্রবাসে ঘরকন্না' (Probase Ghorkonna)। 


বেড়ে ওঠা মেদিনীপুরে। মেদিনীপুর মিশন গার্লস স্কুলের ছাত্রী মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়। আপাতত তাঁর বাস সুদূর আমেরিকায়। ভিন দেশে বসে থাকলেও প্রযুক্তির হাত ধরে আজও তিনি রয়েছেন বাংলার ঘরে ঘরে। কীভাবে হল 'প্রবাসে ঘরকন্না'? সেই সব কথা এবিপি লাইভকে জানালেন মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়। 




এবিপি লাইভ: কীভাবে শুরু?


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: এত মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারব কোনওদিন আশা করিনি। বিদেশ থেকে যখন এখানে আসতাম, আমার আত্মীয় স্বজন, পরিজন, প্রতিবেশীদের ওদেশ নিয়ে খুব আগ্রহ থাকত। কেমন আছি জিজ্ঞেস করার পরই তাদের ছোট ছোট জিনিসের প্রতি খুব কৌতুহল। যেমন ক্লাস ওয়ানে ওখানে কী পড়ানো হয়, আলুর দাম কত, কী কী মাছ পাই, ঝিঙে-পটল পাওয়া যায় কিনা, রাস্তাঘাট কেমন এই রকম নানা বিষয়ে প্রশ্ন করতে শুনেছি। সেখান থেকেই আরও মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার ভাবনা। আমার পরিজনদের মনে যদি এই প্রশ্ন হয়, তাহলে এই প্রশ্ন তো অনেকের। বড় বড় খবর তো আমরা সংবাদমাধ্যমে পাই, কিন্তি এই অতি সাধারণ বিষয়গুলো জানানোর জন্যই এই পথটা বেছে নেওয়া। আমি বলব না এই চিন্তাটা আমারই প্রথম। অনেকেরই আগে এসেছে এরকম করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁদের কাছে এই সোশ্যাল মিডিয়ার মতো প্ল্যাটফর্মটা ছিল না।  


এবিপি লাইভ: কবে থেকে প্রবাসে ঘরকন্নার যাত্রা শুরু?


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: ২০২০ সালের নভেম্বরে চ্যানেলটা করি। একদিন সকালে হঠাৎ করেই ভিডিও রেকর্ড করি। আমার মেয়ে মেহার তখন হোম স্কুল চলছিল। এমনই একটা দিনে ক্যামেরাটা অন করি। আমার প্রথম দিকের ভিডিও দেখলে বোঝা যাবে আমি ঠিক করে ক্যামেরাটাও ধরতে পারতাম না। আমার সব ভিডিওগুলো উল্টো হত। ফটোর এডিট অপশনে গিয়ে যে সোজা করা যায়, তাও জানতাম না। সেটা শিখতেও আমার আরও ২-৩ মাস সময় লেগেছে। প্রথম দিন টুকরো টুকরো কিছু ক্লিপিংস নিই। তখন এডিটও জানতাম না। আমার বন্ধু পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময় খুব সাহায্য করেছে। আমাকে এডিটিং শেখাবে বলে পারমিতা কোভিডের সময় ৪০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে আসে। বাড়িতে দুটো ছোট বাচ্চা আছে বলে ঘরেও ঢোকেনি। ব্যাক ইয়ার্ডে আমার থেকে কার্যত এক ফুট দূরে বসে, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এডিটিং শেখায়। ও ছিল এডিটিংয়ের গুরু।


এবিপি লাইভ: কীভাবে প্রচারের আলোয়?


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: শুরুর দিকে মানে ওই কোভিড লকডাউন ডায়েরি বলে ভিডিও করতাম। সেই সময় তো এরকম রিচ ছিল না। আমার ফেসবুকের বন্ধুরাই দেখত। তাঁরা কমেন্ট করত। সেই থেকেই শুরু। কোনও একটা ভিডিও মাইলস্টোন হিসেবে কাজ করেছে, এরকমটা নয়। আমি বিশ্বাস করি, জিনিস শুরু করা খুব সোজা। শুরু করার আগে ভাবতে হবে আমি কী এটা পারব। আর যেটা করছি সেটা ঠিক না ভুল। আমি যে কোনও জিনিস শুরু করলে তা চালিয়ে যাওয়ায় বিশ্বাসী। পরিশ্রমকে খুব গুরুত্ব দিই। কোনও কিছুই হঠাৎ করে হয়ে যায়নি। একদিন হঠাৎ করে সবার নজরে এসেছি এমন কিছু ছিল না। প্রথম দিকে সপ্তাহে একটা ভিডিও দিতাম। তারপর মনে হল, একটা অনেক কম হচ্ছে। অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। এরপর দুটো, সেখান থেকে চেষ্টা করেছি সপ্তাহে তিনটে করতে। সদূরপ্রসারী ফল চাইলে পরিশ্রম তোমাকে করতেই হবে।




এবিপি লাইভ: সহজ ভাষাই কি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পথ?


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: আমি খুব ছাপোষা ঘরের মেয়ে। বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে। মা সারাজীবন হোমমেকার। তিন ভাইবোনকে মা একা হাতে মানুষ করেছেন। একটা চকোলেট এলে তিন ভাইবোন ভাগ করে খেয়েছি। বেড়ে ওঠাটা খুব সাদামাটা। শ্বশুর বাড়ি হোক বা আত্মীয় স্বজন, সবাই বড় আন্তরিক। সবার ক্ষেত্রেই দেখেছি গুণটাই তাঁরা বেশি বড় করে দেখেছে। এভাবেই বড় হয়েছি। 


এবিপি লাইভ: পাশে ছিলেন কে? 


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: সত্যি কথা বলতে প্রথমেই তেমনভাবে কেউ সাপোর্ট করেনি। আমাদের বাড়িতে আজ অব্দি ইউটিউবে ভ্লগ করব, এরকম ভাবেনি। যদিও ভাই একবার করেছিল। কিন্তু পরে ছেড়ে দিয়েছিল। কেউ বিপক্ষে ছিল তেমনটা নয়। আবার খুব উৎসাহ জুগিয়েছে তাও নয়। দেশে আসার পর মনে হয়েছিল এত সাধারণ কথা জানার জন্য যখন সবার উৎকন্ঠা, তখন তো আমিও জানাতে পারি। আমার স্বামীও প্রথমে বিষয়টায় ভয় পেয়েছিল। আমি ওঁকে দেখাই, লাইফস্টাইল ভ্লগ। তারপর বোঝাই কীভাবে সবাই সাধারণ বিষয়গুলি জানাতে চাই। 


এবিপি লাইভ: ট্রোলিংয়ে ভয় করে? 


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: যেটা পোস্ট করব, সেটা করার আগে দু থেকে তিনবার চেক করব। সবসময় বিশ্বাস করি, আমি যদি ঠিক হই যে ট্রোল করবে সে একদিন চুপ করে যাবে। 


এবিপি লাইভ: ক্লান্ত লাগে কখনও? 


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: রান্না করতে গেলে ক্লান্ত লাগে। আমার ছেলে রামাকে খাওয়াতে ক্লান্ত লাগে। অনেকেই মনে করেন এটা আমার পেশা। কিন্তু আমি কখনই এটাকে পেশা বলে মনে করি না। এটা আমার নেশা। ভাল কিছু দেখলেই মনে হয়, এটা ভিডিও করে রাখি। বাচ্চারা ঘুমালে তখন আমি এডিটিং ভয়েস ওভারে কাজ নিয়ে বসি। তখন ভাললাগাটা অনেক বেশি থাকে। পেশাকে চালিয়ে যেতে হয় জোর করে। কিন্তু এটা আমার ভাললাগার জায়গা, একেবারেই আমার নেশা। মাঝে একবার হ্যাকিংয়ের জন্য় মানিটাইজ়েশন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার কখনও মনে হয়নি টাকা আসছে না কেন ভিডিও করব। যতটুকু আমার জানানোর আছে, ততটুকু জানাতে থাকব। 




এবিপি লাইভ: কনটেন্ট ক্রাইসিসের ভয় হয়?


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: একটা দেশের একাধিক দিক রয়েছে। একটা গোটা দেশ পড়ে আছে আমার দেশকে জানানোর জন্য। এই ধরনের ভয় আমি সত্যি পাই না। কোনও কিছু হঠাৎ মনে এলে লিখেও রাখি। মাথায় পাহাড়প্রমাণ কনটেন্ট রয়েছে। ভয় একটাই শারীরিক কারণে যেন ভ্লগ করায় বাধা না পড়ে যায়। আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থাকে আমি এরপর ভ্লগের মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই। কোথায় আলাদা হচ্ছে, কীভাবে উন্নতি করছে তার তো বহুমুখী দিক রয়েছে। 


এবিপি লাইভ: নতুন কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের টিপস: 


মহুয়া গঙ্গোপাধ্যায়: অনেক বড় একটা এরিয়া। এক্ষেত্রে আসার জন্য কোনও ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। জবাবদিহি করতে হবে না। এই কাজ শুরুর আগে একশোবার ভাবতে হবে। এসে গেলে পরিশ্রম করতে হবে। কাজে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। ভাবলে, পরিশ্রম করলে অবশ্যই সাফল্য আসবে। 


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।


আরও পড়ুন: Success Story: চাকরি করতে করতে প্রস্তুতি, কোনও কোচিং ছাড়াই BDO-র পদে গার্গী