কলকাতা: মহাষ্টমী। উপাচার মেনে পুজো (durga puja) চলছে। তবে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তি (durga idol) নয়,আরাধনা (worship) হচ্ছে এক খুদে চিন্ময়ীর (female child)। শতকের পর শতক ধরে বাঙালির কাছে এই উপাসনা 'কুমারী পুজো' (kumari puja)হিসেবে সমাদৃত। এখানে দেবী দুর্গার মূর্তির সামনে এক শিশুকন্যাকে (পড়ুন কুমারী) বসিয়ে পুজো করাই রীতি। কিন্তু কোথা থেকে সূত্রপাত এই পুজোর?উপাসনায় কী কী লাগে? কেনই বা আমাদের বাংলায় এই রীতির এত রমরমা?
কী বলছে হিন্দুশাস্ত্র?
'কুমারী পুজো'-র উৎস নিয়ে কোনও পৌরাণিক ব্যাখ্যান রয়েছে কিনা সে ব্যাপারে দুটি মত উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ এ নিয়ে 'চণ্ডীগ্রন্থ'-র একটি শ্লোকের কথা বলছেন। এখানে দেবীকে 'প্রসীদ কৌমারীরূপে'আর্জি জানানো হয়েছে। শাস্ত্র নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের মতে,দেবী যাতে কুমারী রূপেও প্রসন্ন হন এই শ্লোকে তারই স্তব করা হচ্ছে। বিশিষ্ট পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বললেন,'কুমারী রূপে একেবারে যে নির্মল ভাবটি ফুটে ওঠে, এখানে তার কথাই বলা হয়েছে।' তাঁর ব্যাখ্যা,কুমারী পুজো-তেও দেবীর সেই ভাবেরই আরাধনা করা হয়। যেখানে বড় বড় সন্ন্যাসী ও সাধকরাও এক শিশুকন্যার সামনে নতজানু হয়ে তাকে দেবীরূপে পুজো করেন। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট পুরাণবিদের আরও সংযোজন,'অন্য শ্লোকে দেবী কিন্তু এও বলেছেন যে জগতে যত স্ত্রী আছে,সব আমি।'কিন্তু কুমারী পুজোর মূল সূত্র শিশুর নির্মল ভাবে। তবে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির মতে,'দুর্গাপুজোর বাধ্যতামূলক অঙ্গ নয় কুমারী পুজো।'
শাস্ত্র নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের আর একটি অংশ অবশ্য কিছুটা অন্য মতামত দিচ্ছেন। সেই মত অনুযায়ী,নিয়ম বলছে যে দুর্গাপুজোগুলি বাড়িতে হয়,তার সবকটিতেই কুমারী পুজো হওয়ার কথা। শুধু তা-ই নয়। রীতি অনুযায়ী,মহাষ্টমী ও মহানবমী দুদিনই কুমারী পুজো হওয়া উচিত। তবে বিশেষ কোনও কারণে বাধা পড়লে পুজো নাও হতে পারে। বারোয়ারি পুজোগুলির ক্ষেত্রে অবশ্য এখন মহাষ্টমীতেই এই আরাধনা দেখা যায়। তাও সর্বত্র নয়। কুমারী পুজোর উৎস হিসেবে হিন্দুশাস্ত্রের অন্য একটি অংশের আবার ব্যাখ্যা,ব্রহ্মা একসময় দেবী দুর্গাকে নগ্নিকা বালিকা হিসেবে দেখেছিলেন। সেখান থেকেই এই কুমারী পুজো শুরু।
এখন যে রীতিতে পুজো...
সাধারণত মহাষ্টমীতে এই পুজো হয়। শিশুকন্যা বা কুমারী কন্যাকে মাতৃমূর্তির সামনে বসিয়ে আরাধনাই দস্তুর। তবে তার আগে তাকে স্নান করিয়ে সাজানো হয়। মাতৃমূর্তির মতো তাকেও আরতি করেন সাধক ও পূজারিরা। দেবীকে যে ভোগ দেওয়া হয়,তাকেও সেই ভোগই নিবেদন করা হয়। ফুল দেওয়া হয় তার পায়ে। প্রণাম করেন সাধকরা। বাগবাজার সর্বজনীন,শোভাবাজার রাজবাড়িতে এই পুজো এখনও সাড়ম্বরে হয়। তবে দেশবিদেশ থেকে ভক্তের দল কুমারী পুজো দেখতে যেখানে ভিড় করেন,তার নাম বেলুড় মঠ। ধুপ-ধুনো-আরতি,সঙ্গে ঢাকের বোল। দুর্গাপুজোর বাকি ঠাঁটটা একই রকম।
বেলুড় মঠ ও কুমারী পুজো...
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০১ সালে এখানে দুর্গাপুজো শুরু করেন। কুমারী পুজো সেই পুজো পদ্ধতির অন্যতম অংশ। শ্রী রামকৃষ্ণ মনে করতেন, জগতের কর্ত্রী সবচেয়ে পবিত্র রূপে একটি নির্মল বালিকার মধ্যে দিয়েই ধরা দেন। সেই বিশ্বাস থেকেই এখানকার কুমারী পুজো। স্বামী বিবেকানন্দ একাধিক কুমারীর পুজো করতেন। এখন একজন কুমারীর আরাধনা হয়। কাতারে কাতারে মানুষ সেই উপাসনা দেখতে ভিড় জমান।
তবে এমন নয় যে হিন্দুশাস্ত্রের এই রীতি স্রেফ নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তাই পেয়েছে। একজন মেয়ে কেন শুধু কুমারী রূপেই পবিত্র, এ প্রশ্ন তুলে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। তবে রীতিতে ছেদ পড়েনি,ভাঁটা পড়েনি জনপ্রিয়তায়। তর্ক-বিতর্ক পেরিয়ে শারদীয়ার আমেজ মেখে জারি রয়েছে চিন্ময়ীতে মৃন্ময়ী পুজোর এই দস্তুর।
আরও পড়ুন:৪০০ বছরের ট্র্যাডিশন মেনে আজও সাড়ম্বড়ে পালিত 'সাত ভাইয়ের পুজো', কেন এমন নাম