কলকাতা : পঞ্চায়েত নির্বাচনে একবার জিতে আসা মানেই বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করার আইনি সম্মতি। দুর্ভাগ্যবশত, অনেকের কাছে এটা মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ নয়। এটা 'মধুভাণ্ড'। তাই এই মধুভাণ্ডের দখলদারি নিয়ে অন্তহীন বিবাদ, হিংসা, রক্তপাত চলছে। কেন বারবার ফিরে আসছে এই রক্তপাতের ছবি ? অনেকেই বলছেন, এর কারণ লুকিয়ে অর্থনীতিতে। অর্থই সব অনর্থের মূলে ! ১৪তম অর্থ কমিশনের সুপিরশমত, আগের সেই ৬৫ কোটি টাকা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ কোটি টাকা । কেন্দ্রীয় অনুদানের ৬০ শতাংশই যায় গ্রাম পঞ্চায়েতের ভাঁড়ারে। প্রতি বছর গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো ২ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পায়। এর মধ্যে আবার হাজারটা গ্রাম পঞ্চায়েত এমন আছে যারা বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা অনুদায় পায়। এছাড়াও জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলি আলাদা করে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি রূপায়ণের টাকা পায়। কাজেই এত এত টাকার নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ পাওয়ার জন্যই কি পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে বারে বারে ফিরে ফিরে আসে হিংসার ছবি ? কী মনে করছেন আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। এনিয়ে এবিপি আনন্দের 'মহাযুদ্ধ'-র অনুষ্ঠানে এসে নিজের মতামত জানালেন বিশিষ্ট অভিনেতা তথা নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন (Kaushik Sen)। যিনি বারবার রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে সরব হয়েছেন । আগের আমলের মতই যথেষ্ট ব্যতিক্রমীভাবেই বর্তমান আমলেও। 


কৌশিক বলছেন, "দুর্ভাগ্যবশত, কোথাও ইতিমধ্যেই আমরা ২০১৮-র ছায়া দেখতে পাচ্ছি। যদিও খবর, কেন্দ্রীয়বাহিনী এসে গেছে। আমরা আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। অন্তত মনে মনে চাইছি, তা-ই হোক। কিন্তু, সত্যি সত্যিই কতটা শান্তিপূর্ণভাবে ভোটটা হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। আমি শেষবার যখন 'যুক্তি তক্কো'র অনুষ্ঠানে এসেছিলাম, সেবার বিষয়টা ছিল- দুর্নীতি। কিন্তু, আমি খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই দুর্নীতির আলোচনায় পঞ্চায়েতের প্রসঙ্গটা টেনে এনেছিলাম। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, ২০১৮-তে মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়েই তৃণমূল যে ভয়ঙ্কর কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল, সেটা থেকে মুক্ত হওয়ার একটা প্রচেষ্টা তৃণমূলের করা উচিত। তৃণমূল করবে বলে আমার মনে হয়েছিল। আমি দুর্নীতির সঙ্গে ওটাকে মিলিয়েছিলাম।" 


কৌশিকও মনে করেন, হিংসার জায়গাটা অর্থনীতির সঙ্গে ভয়ঙ্করভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর বক্তব্য, "বেলাগাম হিংসা কথাটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। কারণ, হিংসাকে লাগাম পরানো যায় না। তৃণমূল কংগ্রেস দু'টো ভুল করল। অর্থাৎ, নিজেদের ভুলটা থেকে শিক্ষা নিল না। ২০১৮ সালে যে ভুলটা করেছিল, সেখান থেকে তারা শিক্ষা নিতে পারতো। সেটা করল না। এমনকী তাদের সামনে ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের ইতিহাসটাও রয়েছে, বামফ্রন্ট অন্তত হিংসাতে লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, লাগাম পরানো যায়নি। কারণ, আমরা বামফ্রন্ট আমলেও যখন পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখেছি, তখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছিল না। কিন্তু, আমরা জানি গ্রামে গ্রামে কী ভয়ঙ্কর রকম অত্যাচার হতো। এখন যেটা হয়েছে, ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে গেছে। একটা গান আছে, ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে গেছে, ময়লা লাগবে গায়ে, গন্ধ ছাড়বে। বামফ্রন্ট আমলে যে ময়লাটা ম্যানহোলের তলায় ছিল, তৃণমূল এসে সেই ঢাকনাটা একেবারে খুলে দিয়েছে। ফলে, এখন দুর্গন্ধটা প্রকট, প্রচণ্ড। অথচ তৃণমূল চাইলে এটা করতে পারতো। কারণ, বামফ্রন্টের অনেকগুলো গন্ডগোলেন মধ্যে একটা তো ছিল-হিংসা, মানুষকে ভোটাধিকার প্রয়োগ না করতে দেওয়া। এইটা নিয়ে একটু একটু করে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। তারপর নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, নেতাই ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে সেই বিস্ফোরণটা ঘটে। একটা পালাবদল ঘটে। এর সাথে সাথে আমরা আশা করেছিলাম, তৃণমূল একটা নতুন কোনও বার্তা নিয়ে আসবে। নতুন বার্তা তো দূর স্থান। তৃণমূল সিপিএমের হিংসাটাকেই অনুসরণ করল। সেটা আরও ভয়াবহ এবং সেটা থেকেও তারা শিক্ষাগ্রহণ করল না। ফলে, যখন মনোনয়নপত্র জমা হয়নি, তার আগে যখন তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে বলা হয়, বিরোধীরা যদি মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারেন, আমাদের বলুন আমরা দিচ্ছি। আপনাদের সকলের মতই আমার কাছে এটা কোনও আশ্বাসের বাণী বলে মনে হয়নি।  আমার কাছে মনে হয়েছিল, চরম অগণতান্ত্রিক কথা। একটা রাজ্য চলছে। পুলিশ প্রশাসন রয়েছে, সেখানে বিরোধীরা যদি মনোনয়নপত্র সঠিকভাবে জমা দিতে না পারে, তারা পুলিশের কাছে যাবে, প্রশাসনের কাছে যাবে, নির্বাচন কমিশনের কাছে যাবে। তারা কেন তৃণমূলকে বলবে ? তৃণমূল নেতৃত্ব এই কথাটা বলেন কী করে যে, আমাদের বলুন আমরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে দেব। এই কথাটার মধ্যেই হিংসা আছে। তখন থেকেই আমরা সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলাম।"