সমীরণ পাল, উত্তর ২৪ পরগনা: এবারও করোনা আতঙ্কে ঐতিহাসিক গোবরডাঙ্গা জমিদার বাড়ির পুজো ঘট পুজোতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। পলাশীর যুদ্ধের আগে প্রায় ৩০০ বছর আগে সূচনা হয়েছিল গোবরডাঙ্গা জমিদারবাড়ির ঐতিহাসিক দুর্গোৎসব। গত দু'বছর ধরে করোনার করাল গ্রাসে ঘট পুজো টুকুই হচ্ছে। তবে ঐতিহ্যে এতটুকু ভাটা পড়েনি গোবরডাঙ্গার জমিদারবাড়িতে। পূর্ব পুরুষ শ্যামলাল চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে পলাশীর যুদ্ধের কিছুদিন আগে সূচনা হয়েছিল গোবরডাঙ্গার ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ির পুজোর। এরপরে শ্যামলালের ছেলে খেলারামের আমলে জমিদারি আরও বিস্তৃত হয়, স্বাভাবিক ভাবেই পুজোর ব্যাপ্তি আরো বেড়ে যায়।
এই ঐতিহাসিক গোবরডাঙ্গার জমিদার বাড়ির পুজো এবারও ঘটপুজোয় সীমাবদ্ধ থাকার কারণ হিসেবে জমিদার বাড়ি বংশধররা জানান ভয়াল করোনার গ্রাসে তাঁদের বেশ কয়েকজন নিকট আত্মীয় স্বজন মারা গেছেন। এছাড়াও এখনও তৃতীয় ঢেউ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণেই এবারেও পুজোয় জমক নেই। পুজো হবে মূল জমিদার বাড়ির বাইরে প্রসন্নময়ী কালী মন্দিরে। গোবরডাঙ্গার জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য , গৌরব ৩০০ বছরের। জমিদার খেলারামের আমলে জমিদারি বিস্তৃত হয়। কৃত্তিবাস ওঝার বংশধর এঁরা একসময় সুদূর দেগঙ্গা থেকে শুরু করে হাবরা অশোকনগর গাইঘাটা খুলনার একটি অংশ সর্বত্রই ছিল গোবরডাঙ্গা জমিদারি এস্টেট।
একসময় এই জমিদারি রক্ষা করা নিয়েই শুরু হয় টানাপোড়েন! জমিদার খেলারাম মুখার্জী যে সন্তানহীন! কিছুতেই তাঁর সন্তান হচ্ছিল না! কথিত আছে এরপর এক রাতে স্বপ্নাদেশ পেয়ে গোবরডাঙ্গায় প্রসন্নময়ী কালী মন্দিরের সূচনা করেন তিনি। প্রসন্নময়ী কালী মাতার আশীর্বাদ পেয়ে সন্তান লাভ করেন তিনি। প্রসন্নময়ী কালী মাতার কৃপায় সন্তান লাভ করায় তিনি সন্তানের নাম দেন কালীপ্রসন্ন। তারপর থেকেই এই বংশের নবজাতকদের নামের সঙ্গে প্রসন্ন যোগ করার রীতি চালু হয়। সে সময়ে যমুনা ছিল স্রোতস্বিনী। যমুনায় করে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ত জমিদারদের জলতরী। ব্যবসাও চলত রমরমিয়ে। দুর্গা পুজোর বোধনের সময় কামান দাগা হত। এমনকী সন্ধিপুজোর আগেও কামান দাগার রেওয়াজ ছিল। গ্রাম গঞ্জের মানুষ পুজোর সময় নির্ধারণ করত এই কামানোর শব্দেই। পুজোর জাঁকজমকের কোনওরকম অভাব ছিল না বিসর্জন দেওয়া হত যমুনা নদীতে। আর বিসর্জনের শোভাযাত্রা ছিল দেখার মতো। বড় বড় দশ-বারোটি হাতি সুন্দর করে সুসজ্জিত করা হত। পাইক-বরকন্দাজরা দুর্গা মাকে নিয়ে যেতেন ইছামতি নদীতে। চলত ভাষান পর্ব।
সে সব এখন স্মৃতির পাতায়। আজ সেই জমিদারি থাকলেও নেই সেই জৌলুস। তবুও প্রতিবছরই ঐতিহাসিক পুজোয় একত্রিত হতেন জমিদারবাড়ির সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা পরিজনরা। পুজো নিয়ে আগ্রহের শেষ ছিল না ভক্তদের। কিন্তু গত দু'বছর ধরে করোনার দাপটে সেভাবে দেবীমূর্তি তৈরি করে আর পুজো হচ্ছে না। অদ্ভুত শূন্যতা ঠাকুরবাড়ির পুজো দালানে। এবার প্রসন্নময়ী কালীমন্দিরে এবারও ঘট পূজো হবে। প্রতিদিন নিয়ম নিষ্ঠ ভাবে হবে পুজো। কিন্তু সেই জাঁকজমক অনুপস্থিত। স্বভাবতই মন ভাল নেই গোবরডাঙ্গাবাসীর তথা গোবরডাঙ্গা জমিদার পরিবারের। তাঁদের আশা মায়ের আশীর্বাদ এ আগামীবার এই করালগ্রাস কেটে যাবে এবং আগামী দিনে জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো হবে গোবরডাঙ্গা রাজবাড়িতে। সেই আশাতেই এখন দিন গুনছেন তাঁরা।