কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, কলকাতা: নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে এই মুহূর্তে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। তার মধ্যেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে (Rabindra Bharati University) অশান্তি চরমে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী (Sabyasachi Basu Ray Chaudhury)। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) তিনি জোড়া চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। রাজ্যের তরফে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে তাঁর পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে এবিপি আনন্দের মুখোমুখি হয়ে জানালেন তিনি। 


দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে জোড়া চিঠি মমতাকে, মুখ খুললেন রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য


টানা ১০ বছর ধরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর দায়িত্ব পালন করছেন সব্যসাচীবাবু। কিন্তু বিগত ১৭ দিন ধরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেই পারছেন না বলে জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গত কয়েক মাস ধরেই দেখতে পাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র এবং কিছু শিক্ষাকর্মী চত্বরে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন, যেখানে বিভিন্ন সময় শিক্ষক, আধিকারিক এবং উপাচার্যের দফতরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তাঁরা। সবসময় যে বিক্ষোভের কারণগুলি সঙ্গত, এমনও নয়। গত ১৮ জুলাই শেষ বার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন ছাত্রদের বক্তব্য ছিল, লাইব্রেরিতে বই নেই। আমি বলি, না থাকলে তালিকা তৈরি করে লিখিত জমা দিতে। বই নিশ্চিত ভাবেই আছে, পত্রপত্রিকাও আছে। তা-ও নির্দিষ্ট কোনও বই লাগলে, লিখিত ভাবে জানালে, তা সমাধানের চেষ্টা করব। আর্থিক সঙ্কট থাকলেও বইয়ের প্রয়োজনীয়তা অগ্রাধিকার পাবে।’’


সব্যসাচীবাবু আরও বলেন, ‘‘আমার ঘরে তখন শিক্ষক, আধিকারিকরা ছিলেন। ছাত্ররা চলে গিয়ে, ফের ১০ মিনিট পর ফিরে এসে জানান, তাঁরা লিখিত দেবেন না। বরং অন্য প্রশ্ন তোলেন। জানতে চান, রেজিস্ট্রার কেন দফতরে আসেননি। আমা জানিই, ছুটিতে রয়েছেন উনি। ছাত্ররা জানতে চান, তার জন্য দরখাস্ত দিয়েছিলেন কি!’ আমি জানাই, হ্যাঁ। এর পর দরখাস্ত দেখতে চান ওঁরা। আমি জানিয়ে দিই, আধিকারিকের ছুটির দরখাস্ত দেখা, ছাত্রদের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এর পর ঘরে বসে নানা মন্তব্য করতে থাকেন ছাত্ররা। জানান, শ্রেণিকক্ষগুলি যেহেতু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, উপাচার্যের দফতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র রয়েছে, তাই প্রতিদিন সকালে সেখানে এসেই অবস্থান বিক্ষোভ করবেন তাঁরা। তার পর থেকেই আর যাওয়া হয়নি।’’


এই বিক্ষোভকারী ছাত্র এবং শিক্ষাকর্মীরা কোনও সংগঠনের কিনা জানতে চাইলে, সব্যসাচীবাবু বলেন, ‘‘কেউ যদিও পতাকা নিয়ে আসেননি, কিন্তু এই ছাত্ররা যে শাসকদলের অনুগত বা অনুগামী, তাতে সন্দেহ নেই।’’ শিক্ষাকর্মীদের একাংশ যাঁরা বিক্ষোভ করছেন, যাঁদের জন্য শিক্ষক এবং আধিকারিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তাঁদের সঙ্গেও শাসকদলের সংযোগ রয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন সব্যসাচীবাবু। তাঁর দাবি, মে মাসে শিক্ষাকর্মীদের শূন্যপদ পূরণে বহিরাগত সংস্থাকে দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। তার ঠিক আগে থেকেই এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। দুইয়ের মধ্যে কোনও সংযোগ রয়েছে কিনা, তা তাঁর জানা নেই বলে দাবি করেন। 


আরও পড়ুন: Arpita Mukherjee: অলঙ্কার থেকে সোনার বার, অর্পিতার ফ্ল্যাটে ‘সোনার খনি’, জানা যাচ্ছে ইডি সূত্রে


সব্যসাচীবাবু জানিয়েছেন, বিষয়টি এর আগে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকেও জানিয়েছিলেন তিনি। এমন ঘটনা ঘটবে না বলে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। তাই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে গত ১০ জুন এবং ১৮ জুলাই, মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি দু’-দু’বার চিঠি দেন বলে জানিয়েছেন সব্যসাচীবাবু। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানান।


এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া চাইলে তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় বলেন, ‘‘এটা ঠিক নয়। দীর্ঘ দিন দায়িত্বে রয়েছেন উনি। তাঁকে এ ভাবে বিরক্ত করা, কাজে বাধা দেওয়া, একেবারেই ঠিক নয়। আমি নিশ্চিত মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন বিষয়টি, যাতে এই পরিস্থিতিত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।’’


সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ মহলের সকলেই জানেন যে, সহ্যের শেষ সীমানায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে ওঁকে। রাজ্যের শিক্ষার কঙ্কালসার চেহারা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। রবীন্দ্রভারতীতে কে কার চেয়ে বড়, তার লড়াই চলছে। তোলাবাজির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সামনে রেখে ইউনিয়ন রুমে ছাত্র সংসদের নেতাদের অশালীনতা মনে পড়ছে কিনা সবার জানি না। সেই সময় ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। অনৈতিক দাপট দেখানোর লড়াই চলছে। তার সঙ্গে রয়েছে টাকা। ওয়েবকুপার যিনি সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই তো কয়েক দিন আগেই বলেছেন যে, কলকাতা এবং যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য সর্বত্র থেকে তোলাবাজি করে শিক্ষা দফতরে টাকা পৌঁছে দেওয়া হতো। উনি তো শিক্ষাবিদ, আর পারছেন না।’’


এ নিয়ে রাজ্য বিজেপি-র নেতা রাহুল সিন্‌হা বলেন, ‘‘এই রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের টাকা উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গেই ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। শিক্ষা বলতে কি আর কিছু আছে! শিক্ষা বলতে গুন্ডামি চলছে। ইউনিয়নের নামে গুন্ডারাজ চলছে। রবীন্দ্রভারতীতেও যদি আমন চলে, উপাচার্য জোড়া চিঠি দেওয়ার পরও মুখ্যমন্ত্রীর তরফে সদর্থক পদক্ষেপ করা হয় না, তাতেই বোঝা যায় শিক্ষা ব্যবস্থার কী অবস্থা। সরকার শুধু টাকা রোজগার টাকা বাঁচানোয় মাথা ঘামাচ্ছে।’’


রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিস্থিতি নিয়ে সরব বিরোধীরা


এর আগে, জুন মাসের শেষে রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য বদল নিয়ে তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় ট্যুইট করেন। ধনকড়কে আচার্যর পদ থেকে সরাতে সেই সময় বিল পাস হয়েছিল বিধানসভায়। তার পরেও সব্যসাচীবাবুর জায়গায় মহুয়া মুখোপাধ্যায়কে নয়া উপাচার্য ঘোষণা করে ট্যুইট  করেন তিনি। ধনকড়ের সেই ট্যুইটের পর মুখ্যমন্ত্রী ফোন করে তাঁকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন বলে জানিয়েছেন সব্যসাচীবাবু। এর আগে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দফতর এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সহযোগিতাও পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এখনও সরকারের তরফে কোনও বার্তা নেই বলে জানিয়েছেন। প্রতিদিন দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে, দফতরে চড়াও হলে, কারও পক্ষে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয় বলে মত তাঁর। 


Education Loan Information:

Calculate Education Loan EMI