কলকাতা : 'ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী' । শেষের কবিতায় অমিত রায়ের মুখ দিয়ে এই কথাটা বলিয়েছিলেন স্রষ্টা। আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলির টানেই হোক কিংবা কলমের আঁচড়ে কিংবা তাঁর সার্বিক জীবনচর্যায়, যে কালোত্তীর্ণ স্টাইলের ছোঁয়া রেখে গিয়েছেন, তা আগামী বছরগুলিতেও আইকন হয়ে থাকবে।



রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় স্টাইল ও ফ্যাশন


স্টাইল আর ফ্যাশনের কথা বলতে গিয়ে সেই অমিত রায়ের মুখ দিয়েই রবীন্দ্রনাথ বলিয়েছিলেন ,'দক্ষযজ্ঞের গল্পে এই কথাটির পৌরাণিক ব্যাখ্যা মেলে। ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ একেবারে স্বর্গের ফ্যাশানদুরস্ত দেবতা, যাজ্ঞিকমহলে তাঁদের নিমন্ত্রণও জুটত। শিবের ছিল স্টাইল, এত ওরিজিন্যাল যে মন্ত্রপড়া যজমানেরা তাঁকে হব্যকব্য দেওয়াটা বেদস্তুর বলে জানত। ' 


ছেলেবেলা থেকেই কি পোশাক-আসাকের বিষয়ে তাঁর এতটাই সূক্ষ্মতার ছোঁয়া ছিল?


কখনও আইকনিক জোব্বার সঙ্গে বাবরি চুল। কখনও আবার লম্বা ঝুলের আলখাল্লা আর বেশ ঢোলা হাতার পোশাক। যৌবনে নিকষ কালো আকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বলে তাঁর স্যুট পরা ছবি।  রবীন্দ্রনাথ মানেই সূক্ষ্ম রুচিবোধের শেষ কথা। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, গোটা ঠাকুর পরিবারই বিভিন্ন সময় পোশাকের ক্ষেত্রে নানা বিপ্লব নিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে,ছেলেবেলা থেকেই কি পোশাক-আসাকের বিষয়ে তাঁর এতটাই সূক্ষ্মতার ছোঁয়া ছিল? নইলে এই রুচিবোধ এল কীভাবে?


ছোট্ট রবির পোশাক ছিল কেমন


ছোট্ট রবির ছেলেবেলায় কেমন পোশাক পরতেন, তাঁর একটা আভাস পাওয়া যায় জীবনস্মৃতিতে। ঠাকুরবাড়ির রেওয়াজই ছিল, বাড়ির ছেলেপুলেদের শৈশব পার হত ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে। তাঁর কথায় , 'চাকরদেরই শাসনের অধীনে ' । তাঁরাই নানাপ্রকারে শিশুদের দস্যিপনা সামাল দিতেন। কখনও ভয় দেখিয়ে, কখনও রামায়ন-কথা শুনিয়ে। সেকালে এহেন অভিজাত বাড়ির শিশুদের জামাকাপড়েরও নাকি বিশেষ আধিক্য ছিল না। শুনলে অবাকই হতে হয়, সে-যুগে খানকয়েক সাধারণ পোশাকেই দিন  কাটাতেন কলকাতার অমন ধনী পরিবারের শিশুরা। তাঁর কথায়, 'কাপড়চোপড় এতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের চক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে।' রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে বলেছেন, বয়স দশের কোঠা পার হওয়ার আগে পায়ে মোজা গলাননি তাঁরা।  শীতের দিনেও গরম উল পশম জ্যাকেট থাকত না ছোটদের জন্য। ছেলেপিলেদের একটা সাদা জামার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হত আর-একটা সাদা জামা। 




বৈভব-বর্জিত শৈশব
বাড়ির বড়দের জৌলুসপূর্ণ জীবনযাত্রা, ধোপদুরস্ত পোশাক সবই অবাক বালক দেখত চেয়ে কিন্তু কোনওদিনই অদৃষ্টকে দোষ দেয়নি। তখন ছোটদের পোশাক-আশাক বানাতেন দর্জি নেয়ামত খলিফা । তিনি আবার কোনও কোনও সময় জামার সঙ্গে একটা পকেট লাগাতেও যেতেন ভুলে। তখন শিশু-মনে একটু কষ্ট হত বৈকি। তবে সে-যুগে শিশুকাল থেকেই বৈভবের সাগরে ডুবিয়ে না দিয়ে সাধারণভাবে বড় করে তোলাই ছিল ঠাকুর-বাড়ির শিক্ষা। 


চটিও থাকত একজোড়াই । রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে কৌতূক করে লিখেছেন,  ' আমাদের চটিজুতা একজোড়া থাকিত, কিন্তু পা দুটা যেখানে থাকিত সেখানে নহে। প্রতি-পদক্ষেপে তাহাদিগকে আগে আগে নিক্ষেপ করিয়া চলিতাম-- তাহাতে যাতায়াতের সময় পদচালনা অপেক্ষা জুতাচালনা এত বাহুল্য পরিমাণে হইত যে পাদুকাসৃষ্টির উদ্দেশ্য পদে পদে ব্যর্থ হইয়া যাইত। '


১৩১৮ সালের ২৫শে বৈশাখ উৎসবের সময় শান্তিনিকেতনে ঘরোয়া আসরে রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠ করেন। তার আগেই তিনি লিখছেন, ' এখনকার কালে ছেলেরা গুরুজনদিগকে লঘু করিয়া লইয়াছে; কোথাও তাহাদের কোনো বাধা নাই এবং না চাহিতেই তাহারা সমস্ত পায়। আমরা এত সহজে কিছুই পাই না।'


ছেলেবেলায় বড়দের  গতিবিধি, বেশভূষা, আহারবিহার, আরাম-আমোদ, আলাপ-আলোচনা তাঁর পরিধি এক আলোকবর্ষ দূরে ছিল। যাঁর আভাস পাওয়া যেত, নাগাল নয়। ভাবতেন, বড় হলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।



রবি ঠাকুর লিখছেন, 'তখন সামান্য যাহাকিছু পাইতাম তাহার সমস্ত রসটুকু পুরা আদায় করিয়া লইতাম, তাহার খোসা হইতে আঁঠি পর্যন্ত কিছুই ফেলা যাইত না। এখনকার সম্পন্ন ঘরের ছেলেদের দেখি, তাহারা সহজেই সব জিনিস পায় বলিয়া তাহার বারো-আনাকেই আধখানা কামড় দিয়া বিসর্জন করে-- তাহাদের পৃথিবীর অধিকাংশই তাহাদের কাছে অপব্যয়েই নষ্ট হয়।' 



বর্তমান যুগে, বেশিরভাগ পরিবারের একমাত্র শিশুর হাত যখন বাবা-মায়ের ভূরি ভূরি উপহারে উপচে পড়ে, যখন ছোট উপহারেও তারা খুশি হতে পারে না, যখন প্রায়শই খবরের শিরোনামে উঠে আসে কিছু আশাপূর্ণ না হয়ে শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা, তখন রবীন্দ্রনাথের এই বাক্যগুলিই কঠোর সত্যিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। হয়ত,  কলকাতার সম্ভ্রান্ততম পরিবারগুলির অন্যতম ঠাকুর পরিবারের ছেলেপিলেরা এভাবে সাধারণ জীবনচর্যার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই ভবিষ্যতে একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশির বিন্দুর মধ্যে আবিষ্কার করেছেন জানার মাঝে অজানাকে। 

তথ্যসূত্র : জীবনস্মৃতি , শেষের কবিতা