সমীরণ পাল, কমলকৃষ্ণ দে, ভাস্কর মুখোপাধ্যায়: রেশন দুর্নীতির (Ration Scam) মামলায় ইডি-র (ED) হাতে গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক (Jyotipriya Mallick)। কিন্তু তারপরেও নায্য়মূল্য়ে সরকারের ধান কেনায় (Paddy Selling Scam) দুর্নীতি কি বন্ধ হয়েছে? উত্তর চব্বিশ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম, পুরুলিয়া থেকে যেসব ছবি এবিপি আনন্দর ক্য়ামেরায় ধরা পড়ল, তা কিন্তু বলছে অন্য় কথা! ধান বিক্রি নিয়ে কথা বলতে গেলেই ক্যামেরা দেখে কেউ মুখ ঘোরালেন, কেউ দিলেন দৌড়। 


রেশন দুর্নীতির মামলায় ইডি-র হাতে গ্রেফতার হয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। আদালতে দেওয়া রিপোর্টে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দাবি করেছে ধান কেনায় নিজেই কমিশন খেতেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী। কিন্তু তারপরেও কি বন্ধ হয়েছে দুর্নীতি? সহায়কমূল্যে ধান বিক্রির ক্ষেত্রে ফড়ে-রাজ কি আটকানো গিয়েছে? চাষিরা কি সরাসরি সরকারি ধান বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ফসল বিক্রি করতে পারছেন? রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জেলায় খোঁজ নিল এবিপি আনন্দ। 


উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম থেকে পুরুলিয়া, যা ছবি উঠে এল, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের নাকের ডগায় এখনও রমরমিয়ে চলছে ফড়ে-রাজ। 


উত্তর ২৪ পরগনা (North 24 Parganas):
বারাসাত ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির অফিস থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এই ছোট জাগুলিয়া সরকারি ধান বিক্রয় কেন্দ্র। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এখানে ধান কেনাবেচার গোটাটাই নিয়ন্ত্রণ করে ফড়ে বা মিডলম্যানরা। কিন্তু কীভাবে? এলাকার চাষিদের একাংশের দাবি, সরকারি ধান বিক্রয় কেন্দ্রের ঠিক সামনেই মাচা তৈরি করে বসে থাকেন ফড়েরা। অভিযোগ, এই ফড়েদের এড়িয়ে সরকারি কেন্দ্রে ধান বিক্রি করা, চাষিদের ক্ষেত্রে কার্যত অসম্ভব। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই, সরকার নির্ধারিত সহায়কমূল্যের থেকে কম দামে ধান এই ফড়েদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন চাষিরা। আর চাষিদের বিক্রি করা ধান পরে, এই ফড়েদের মাধ্যমেই চলে যায় সরকারি ধান বিক্রয় কেন্দ্রে। মাঝের মোটা টাকা কমিশন ঢুকে যায় তাঁদের পকেটে।


বারাসতের ছোট জাগুলিয়ার বাসিন্দা কুণাল ঘোষের দাবি, 'এরা সব দালাল। চাষি কেউ নেই এখানে। অ্যাকাউন্ট নম্বর নেই অর্ধেক চাষির। করবে কী করে? যাঁদের অ্য়াকাউন্ট নম্বর নেই, বাধ্য হয়ে তারা দালালকে বিক্রি করে।'কিন্তু সরকারি ধান বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে মাচা বেঁধে ফড়েদের এই বসে থাকার সাহস হয় কী করে? তাহলে কি সরকারি আধিকারিকদের একাংশই কার্যত সুবিধা করে দিচ্ছেন? ক্যামেরা দেখে ফড়েরা পালিয়ে গিয়েছেন এমন প্রশ্ন করতেই কার্যত মুখে কুলুপ বারাসাত ১ ব্লকের খাদ্য নিয়ামকের। সরকারি নিয়ম থাকা সত্ত্বেও কীভাবে ফড়েরা ধান কেন্দ্রের সামনে বসে রয়েছেন এমন প্রশ্ন করলেও কোনও উত্তর দেননি তিনি। ফড়েদের বাড়বাড়ন্তের নেপথ্যে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির দিকেই আঙুল তুলেছেন চাষিদের একাংশ। স্থানীয় কৃষক আখতার রহমান বিশ্বাস বলেন, 'এখন ওঁদের রাজ আছে। সভাপতি আছে। সবকিছু টাকা দিয়ে ওদেরকে কমিশন দিয়ে, ওঁরা বিক্রি করছেন। ওঁরা প্রমাণ দিতে পারবেন না, ওঁরা চাষি।' পঞ্চায়েত সমিতি কি এর বিনিময়ে টাকা পায়? উত্তরে ওই চাষির দাবি, 'অবশ্যই টাকা না দিলে ওঁরা এই জায়গাটা পাবে কী করে?'


এই ঘটনায় তুঙ্গে উঠেছে রাজনৈতিক তরজা। বিজেপির বারাসাত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তরুণকান্তি ঘোষ বলেন, 'চাষির ফসল গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে। এটাই ফড়েরাজ, এটাই তৃণমূলের রাজ। এটা চলতেই থাকবে তৃণমূল যতদিন ক্ষমতায় আছে।' যদি গোটা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বারাসাত ১ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভানেত্রী হালিমা বিবি। তিনি বলেন, 'সবসময় শাসকদলের দিকে আঙুল তোলাটা বিজেপির কাজ। ওখানে প্রতিদিন পুলিশ পোস্টিং থাকে। সিসিটিভি ক্য়ামেরা রয়েছে। আমাদের প্রতিদিন তত্ত্বাবধান চলে। কোনও চাষি অভিযোগ করবে মানতে পারছি না।'


বীরভূম (Birbhum):
জেলা বদলালে বদলে যাচ্ছে, দুর্নীতির ধরন। বীরভূমের নানুরে ভাল পরিমাণ ধান চাষ হয়। সেখানকার চাষিদের অভিযোগ, এখানে চাষিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কিছু টাকার বিনিময়ে কার্যত নিজেদের দখলে নিয়ে নিচ্ছে দালাল বা ফড়েরা। স্থানীয় চাষি সোমনাথ ঘোষ, 'চাষিদের অ্যাকাউন্ট কিনে নিচ্ছে। এই দালাল চক্র বন্ধ হোক। চাষির কাছ থেকে অ্যাকাউন্ট কিনে, সেই ধান সরকারকে বিক্রি করছে। সরকারের কাছ থেকে সেই মুনাফা চাষি না পেয়ে দালালরা পাচ্ছে।'


পূর্ব বর্ধমান (Purba Bardhaman):
পূর্ব বর্ধমানের মেমারির কৃষকমাণ্ডিতে দেখা গিয়েছে অন্য ছবি। চাষিদের নিয়ে আসা ধান কেনার পর, তা রাইসমিলের মালিকের ট্রাকে ওঠানোর সময় নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। স্থানীয় চাষি ফজলে করিম শেখ বলেন, 'মুটেরা লোডিং করছে, ওই গাড়িতে তুলছে, তাঁরজন্য টাকা দাবি করছে।' 


পুরুলিয়া (Purulia):
পুরুলিয়ার ২ নম্বর ব্লকের হাতোয়াড়ায় কৃষক ভাণ্ডার রয়েছে। সেখানে বেনিয়ম আবার অন্যরকম। সেখানে দেখা গিয়েছে যে রাইস মিলের মালিক চোখে দেখেই প্রতি কুইন্টালে ধানে কতটা বাদ দিতে হবে, তা ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ বেআইনি।


ফড়েদের দাপট বাংলায় নতুন নয়। একদিকে চাষিদের ঠিকমতো দাম না পাওয়া অন্যদিকে বেলাগাম দামের কারণে খুচরো ক্রেতাদের নাভিশ্বাস ওঠা। দুই ক্ষেত্রেই সামনে এসেছে ফড়ে-রাজের অভিযোগ। বারবার ফড়েদের দাপট কমাতে সরকারের তরফে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও কার্যত কোনও কাজই হচ্ছে। ফের প্রকাশ্যে এল তা।


আরও পড়ুন: ফের শীতের কামড় দক্ষিণবঙ্গে! কবে থেকে নামবে পারদ? কতদিন থাকবে?