বিজেন্দ্র সিংহ, নয়া দিল্লি: দুর্নীতির কারণ দেখিয়ে ২০১৬ সালের গোটা প্যানেলটাই বাতিল করেছে- কলকাতা হাইকোর্ট (Calcutta high Court)। তার জেরে চাকরি গিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে (Supreme Court)) গিয়েও ধাক্কা খেল রাজ্য-পর্ষদ-এসএসসি (SSC))। সেখানেও চাকরি বাতিলের (SSC Scam Verdict) রায়ের উপর আপাতত কোনও স্থগিতাদেশ দিল না সুপ্রিম কোর্ট। এ দিন সুপ্রিম কোর্টে যে সওয়াল-জবাব হয়েছে তাতে ঠিক কী কী উঠে এসেছে? জানালেন মামলাকারীদের আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আইনজীবী ফিরদৌস শামিম।


সেগ্রেগিশন নিয়ে প্রশ্ন:
আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'স্কুল সার্ভিস কমিশন কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে বারবার সেগ্রেগিশন থেকে এড়িয়ে গিয়েছে। সত্যিকারের সেগ্রেগিশন করতে পারলে যোগ্য প্রার্থীরা বাঁচবেন।' কিন্তু এই সেগ্রেগিশন মুখে বললে হবে না, সম্পূর্ণ তথ্য রাখতে হবে সামনে। কীভাবে? আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় উদাহরণ নিয়ে বললেন, 'ধরুন ২৫০০০ প্রার্থীর মধ্যে ১৭৫০০ জন যোগ্য। তঁদের নাম, রোল নম্বর, ক্যাটেগরি, বিষয় ভিত্তিক ক্যাটেগরি, মেল না কি ফিমেল-- এই পুরো বিষয়টি ভেঙে ভেঙে দেখাতে হবে। দেখাতে হবে যে এই প্রার্থীদের নিয়ে কোনও অভিযোগ এসে পৌঁছয়নি। এমন অনেক প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের কথা আদালত চিন্তাভাবনা করে দেখবেন। আজ প্রধান বিচারপতির কথাবার্তা শুনে, সওয়াল শুনে মনে হয়েছে।'


কিন্তু স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে এই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। আইনজীবী বলছেন, 'স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে এই তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। নাইসা- কোম্পানিটাকে ব্যাকডোর টেন্ডার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই থিওরির উপর দেখতে গেলে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া চলে যায়। এসএসসি সেটা মেনে নিচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে সেগ্রেগিশন করছে না।'


'সিবিআই ৮ হাজার অযোগ্য প্রার্থীর খোঁজ পেয়েছিল, কেন ২৬ হাজার বাতিল?' হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে এই প্রশ্ন করেছিল রাজ্য সরকারের আইনজীবী। এই প্রসঙ্গে আইনজীবী বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'তাহলে স্কুল সার্ভিস কমিশনেরও চিহ্নিত করা উচিত, যোগ্য কারা। এখনও পর্যন্ত ওই সংখ্য়াটি ৮০০০- এখনও তো তদন্ত চলছে। এরপরে যদি আরও ৫ জনের নাম আসে তাঁদের চাকরি যাবে। SSC এই তথ্য সেগ্রেগিশন করতে চাইছে না। ওরা ওয়েবসাইটে দিতে পারত।' তিনি আরও জানান, আইনে রয়েছে অরিজিনাল ওএমআর নষ্ট করা যায় ১ বছরের পরে। কিন্তু তার স্ক্যান কপি রাখতে হবে-সেটাই তো নেই।


এই মামলায় বারবার প্রশ্ন উঠেছে OMR শিট না থাকা নিয়ে। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও। এই ওএমআর শিটের ডেটা কি আর কোথাও আছে? মামলাকারীর আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, 'প্রধান বিচারপতি বারবার বলেছেন, OMR শিট তো নষ্ট করা হয়েছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রথমে ওএমআর শিট নষ্ট করেছে, তারপর ডিজিটাল কপিও নষ্ট করেছে। নাইসার কর্তা পঙ্কজ বনসলের বাড়ি থেকে সিবিআই যে ডিজিটাল কপি উদ্ধার করেছিল। ৬৫বি সার্টিফিকেট দিয়ে বোঝা গিয়েছিল সেটা গ্রহণযোগ্য। সেই তথ্য থেকেই বোঝা যায় ওএমআর শিটে ম্যানুপুলেশন রয়েছে।'
কিন্তু এখানেই অভিযোগ শেষ নয়। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম জানান, শুধু ওএমআর শিটে ম্যানুপুলেশন ইস্যু নয়। এর বাইরে নন-লিস্টেড প্রার্থীর নিয়োগ, তালিকার মেয়াদ শেষের পর সেখান থেকে নিয়োগ, আনুপাতিক ক্ষেত্রগুলিতে বেনিয়ম হয়েছে। নিয়োগের সব ধাপে নিয়মভঙ্গ হয়েছে বলে জানান তিনি। তাঁর সংযোজন, 'যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। ২০২১ সালে এই প্রধান বিচারপতিরই রায় রয়েছে একটি মামলায়- যদি অযোগ্য ও যোগ্য প্রার্থীদের আলাদা না করা যায়, তাহলে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যায়- এখানেও সেটাই হয়েছে।'


সেকেন্ডারি ডেটার প্রসঙ্গ:
পঙ্কজ বনসলের বাড়ি থেকে যে তথ্য উদ্ধার হয়েছে তাকে সেকেন্ডারি ডেটা বলা হয়েছে। আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, 'আমরা বলছি সেটাই প্রাইমারি ডেটা। কারণ ৬৫বি শংসাপত্র দিয়েছে, গ্রহণযোগ্য রয়েছে। OMR শিট মানে অপটিক্যাল মার্ক রেকগনিশন। সেখান থেকে প্রথম ডেটা স্টোর হয় ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট হিসেবে। সেটাই প্রাইমারি ডেটা হিসেবে স্টোর হয়ে যায়। এবার সেখান থেকে ২টি কপি দেওয়া হয়েছিল। একটা সংস্থার কাছে ছিল, অন্যটা এসএসসি-কে দেওয়া হয়েছিল। SSC দুর্নীতি করবে বলে নিজের ডিজিটাল ডেটা নষ্ট করা হয়েছে। এসএসসি যে ট্যাবুলার চার্ট দিয়েছে সেটা সম্পূর্ণ নেই, আমরাই তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি।'


আরও অভিযোগ:
এসএসসি ওএমআর মূল্যায়ন করতে দিয়েছিল নাইসা-কে। সেই নাইসা আবার আরেকটি থার্ড এজেন্সিকে সেই দায়িত্ব দেয়- তার নাম ডেটা স্ক্যান টেক। এসএসসির চেয়ারম্যানকে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জিজ্ঞেস করেছিল যে  এই সংস্থার নাম শুনেছেন কিনা। কিন্তু তখন এসএসসির চেয়ারম্যান জানান, তিনি এই সংস্থার নামই শোনেননি- এমনটাই জানিয়েছেন ফিরদৌস শামিম।   


অতিরিক্ত শূন্য়পদ তৈরি বিষয়টি নিয়ে সিবিআই তদন্তে অন্তর্বতীকালীন স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের মতে, অতিরিক্ত শূন্য়পদ তৈরির সিদ্ধান্তে যুক্ত সবাইকে তদন্তের আওতায়  আসতেই হবে। কারণ হিসেবে তাঁর দাবি, 'তালিকার মেয়াদ ফুরনোর পরে অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরি হচ্ছে। ক্যাবিনেট মেমোরেন্ডামে বলা হচ্ছে নিয়মভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু ক্যাবিনেট কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্য়ানেলের মেয়াদ ফুরনোর পরেও নিয়োগের ব্য়বস্থা করছে। সরকার, বোর্ড ও এসএসসি- যোগ্য ও অযোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করতে পারছে না। সরকারের প্রধান বলছেন কারও চাকরি যাবে না। কেন বেআইনিভাবে নিয়োগ পাওয়াদের চাকরি থাকবে? সরকারের প্রধান যখন বলছেন তখন সেটাই স্ট্রিমলাইন হয়ে সরকারের একেবারে নীচের তলায় আসছে, স্বাভাবিকভাবেই সেভাবে কাজ হচ্ছে।'


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে। 


আরও পড়ুন: ২৬ হাজার চাকরি-বাতিলের নির্দেশ বহাল! নিয়োগ-মামলা নিয়ে কী জানাল সুপ্রিম কোর্ট?