জয়দীপ হালদার, দক্ষিণ ২৪ পরগণা: গত ১০ জুন প্রকাশিত হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক ২০২২-এর (HS results 2022) ফলাফল। ঘোষিত হয়েছে ২৭২ জনের মেধাতালিকা (Merit List)। তাঁদের মধ্যে নাম ছিল পাথরপ্রতিমার সৌমেন পাত্রের (Soumen Patra)। রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে অষ্টম স্থান (8th rank) অধিকার করেছে সে, প্রাপ্ত নম্বর ৪৯১। কিন্তু আর্থিক অনটন বড় বালাই। এত নম্বর পেয়েও পড়াশোনার সফর এখানেই থামিয়ে দিতে চলেছে সৌমেন। দারিদ্র্য (poverty) কেড়েছে তাঁর স্বপ্ন।
পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পথে সৌমেনের
স্বপ্ন ছিল সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্নের মুখে এখন আস্ত একটা প্রশ্নচিহ্ন। আর্থিক অনটনের শিকার উচ্চ মাধ্যমিকে অষ্টম স্থানাধিকারী দক্ষিণ ২৪ পরগণার পাথরপ্রতিমার শ্রীধরনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপেন্দ্রনগরের বাসিন্দা সৌমেন পাত্র। কাকদ্বীপের বামানগর সুবলা উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছে ৪৯১।
ছোট থেকেই দারিদ্র্য তাঁদের নিত্যসঙ্গী। বাবা-মা দুই জনেই দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। বাবা তপন পাত্র দিল্লিতে গাড়ি ধোয়ার কাজ করেন। মা অনিমা পাত্র পরিচারিকার কাজ করেন। হাজার সমস্যার মধ্যেও কোনওদিন পড়াশোনা ছাড়েননি সৌমেন। এক সময়ে পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের সঙ্গে মোকাবিলা করতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে নিজেও দিল্লি পাড়ি দেয় সে। এক ছোটখাটো সংস্থায় জুটিয়ে নেয় কাজ। সেখানে বসেই উচ্চ মাধ্যমিকে নিজের দুর্দান্ত ফলাফলের খবর পায় সে। জানতে পারে নাম উঠেছে মেধাতালিকায়। মনে নতুন করে উঁকি দেয় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। ফিরে আসে বাড়ি। কিন্তু ফের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবারের চরম আর্থিক সঙ্কট।
সৌমেনের ইচ্ছে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। অনেক সমস্যা হলেও দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত যা হোক করে ছেলের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন মা-বাবা। কিন্তু এরপরের উচ্চশিক্ষার খরচ কীভাবে টানবেন সেই ভেবে মাথায় হাত পড়েছে তপন পাত্রের। তিনি বলেন, 'উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে কোনওরকমে খরচ চালিয়েছি। এরপর ছেলের পড়াশোনার খরচ আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় রয়েছি।'
আশাহত সৌমেন পাত্রের কথায়, 'ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কোনও উপায় ছিল না। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে তাই বাবা-মার সঙ্গে দিল্লি চলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে বাবা-মাকে দিল্লি থেকে গ্রামে ফিরিয়ে আনব। কিন্তু কোনও আশার আলো দেখতে পাচ্ছিনা। যদি কোনওভাবে কিছু না হয় তাহলে আবার বাধ্য হয়ে দিল্লিতে কাজে চলে যেতে হবে। সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে অনেক টাকার খরচ।'
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় সৌমেনদের অ্যাসবেসটস দেওয়া প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পাওয়া বাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। বাড়ির মধ্যে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। সৌমেনের দিদি শম্পা বর্মন বলেন, 'ভাই বরাবরই মেধাবী ছাত্র। মাধ্যমিকে কয়েক নম্বরের জন্য স্টার হাতছাড়া হয়েছিল। তাই জেদ ছিল উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করবে। পরিবারে অভাব। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বাবা-মা সকলেই দিল্লিতে থাকে। আমরা সবাই ওর সাফল্যে আনন্দিত। কিন্তু ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে না বাবা-মা। ভাইয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সরকার যদি এগিয়ে আসে তাহলে ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে।'
আরও পড়ুন: Kolkata News: নজরদারি এড়িয়ে গাছে উঠে পড়লেন রোগী, ডাকতে হল দমকল, ফের বিতর্কে পাভলভ মানসিক হাসপাতাল
ইতিমধ্যে সৌমেনের পাশে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান। শ্রীধরনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান প্রদ্যুৎ বর্মন বলেন, 'সৌমেন সুন্দরবন তথা পাথর প্রতিমার গর্ব। ছোটবেলা থেকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও লড়াই করছে। আর্থিক অনটনকে হার মানিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে এত ভাল ফল করেছে। অর্থের অভাবে মেধা তলিয়ে যাবে, এটা হয় না। সৌমেনের পাশে সবরকম সাহায্যের জন্য আমরা আছি।'
পারিবারিক অভাবকে কাটিয়ে ভবিষ্যতের একরাশ স্বপ্ন চোখে। দারিদ্র্যকে হার মানিয়ে সৌমেনের স্বপ্ন কি আদৌ পূরণ হবে? আদৌ কি সে কোনও সাহায্যের হাত পাবে? সেই অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে মেধাবী সৌমেন পাত্র।