কৌশিক গাঁতাইত, জামুড়িয়া : করোনা অতিমারি এবং লকডাউনের জেরে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ স্কুল। অনলাইন ক্লাসের আওতায় যারা রয়েছে, তারা কিছুটা পড়াশোনার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু রাজ্যে এমন অনেক পরিবারের শিশু রয়েছে, যাদের অনলাইন শিক্ষা নেওয়ার সামর্থ্য নেই। নেই প্রাইভেট টিউশন নেওয়ারও আর্থিক ক্ষমতা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে তারা পড়াশোনার বাইরে। সেই সমস্ত হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিলেন জামুড়িয়ার তিলকা মাঝি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়েক। শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে অভিনব পদ্ধতিতে শুরু করেছেন শিক্ষাদান। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। যাদের সামান্য খাতা কিংবা পেন কেনারও ক্ষমতা নেই। কিন্তু অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের মতো তাদেরও রয়েছে শিক্ষার অধিকার। শূন্য থেকে শুরু নাম দিয়ে শনিবার থেকে নতুন কর্মসূচী শুরু করেছেন শিক্ষক দীপনারায়ণ নায়েক। লকডাউনের সময়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে নিজেকে রাস্তার শিক্ষক বলেও প্রতিষ্ঠা করেছেন।  


জামুড়িয়ার জবা কাঁঠালপাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, কেউ বসে একমনে পড়ছে, কেউ লিখছে, কেউ আবার ছবি আঁকছে। কিন্তু তাদের কারও কাছে বই নেই। নেই কোনও খাতা বা পেন। এমনকি নিজস্ব কোনো স্লেটও নেই তাদের কাছে। তাহলে তারা পড়াশোনাটা করছে কোথায় বা কীভাবে? এখানেই অসাধ্য সাধন করেছেন মাস্টারমশাই। আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের কাঁচা মাটির বাড়ির দেওয়ার মসৃন করে তাতেই ব্ল্যাকবোর্ড তৈরি করে সেখানেই শুরু করেছেন শিক্ষাদানের কাজ। স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাসিন্দাদের কাঁচা মাটির ভগ্নপ্রায় দেওয়ালগুলিতে পাকা রং করে সেগুলোকেই শিক্ষার সহায়ক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। সুপরিকল্পিত উপায়ে এভাবেই তৈরি করে ফেলেছেন ব্ল্যাকবোর্ড। সেখানেই লিখেছেন বর্ণপরিচয়। এবিসিডি থেকে শুরু করে করোনা থেকে বাঁচার উপায়। এমনকি এসবের পাশাপাশি ভ্যাকসিনের গুরুত্বের কথাও একইসঙ্গে সেখানে তুলে ধরেছেন তিনি। এর ফলে আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন 'দুয়ারে স্কুল' বা 'দুয়ারে শিক্ষা' পাচ্ছে, তেমনই আদিবাসী মানুষদের মধ্যেও শিক্ষা সটেতনতা গড়ে উঠছে।


শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জীবন ও আদর্শকে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে তুলে ধরে দীপনারায়ণ নায়েক জানাচ্ছেন, এখানকার বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। অর্থাৎ, এদের অভিভাবকেরা কেউই প্রথাগত শিক্ষার আলো দেখেনি। তাই এখানে শিক্ষা বিস্তার তিনি 'শূন্য় থেকে শুরু' করছেন। তাই তাঁর শিক্ষাদানের নামও তিনি 'শূন্য থেকে শুরু' রেখেছেন। তিনি বলছেন, 'এই কর্মসূচীর মাধ্যমে সমাজের সমস্ত কুসংস্কারকে দূর করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। শিক্ষাদানের মাধ্যমে বিজ্ঞান সচেতনতার কাজও চলছে।'


আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সমস্ত কুসংস্কারগুলো রয়েছে, সেগুলোকে দূর করার জন্য 'বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে' বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন 'রাস্তার শিক্ষক' দীপনারায়ণ নায়েক। এদিন তিনি আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের ফুলের পরাগ থেকে শুরু করে ম্যালেরিয়ার জীবানু অনুবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করান। এতদিন এই সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ধারণা ছিল যে, ম্যালেরিয়া কোনও 'ভূতে ধরা' বা 'দূষিত বাতাস' ঘটিত রোগ। এবার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে যে, ম্যালেরিয়া আসলে জীবানু ঘটিত একটা অসুখ। মাইক্রোস্কোপের নিচে ম্যালেরিয়া রোগের জীবানুকে দেখে অবাক অভিভাবকেরাও। তাঁরা অবাক হয়ে বলছেন, 'ও এতদিনে বুঝলুম জ্বরে কাঁপুনিটা একটা রোগ, ভূতে লাগা লয়!'


শিক্ষক মশাইয়ের এই পড়াশোনায় খুশি ছাত্রছাত্রীরাও। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া টুডু, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মন্দিরা ওরাং 'দুয়ারে শিক্ষা' পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে বলে, 'আমরা আঠেরো মাসের বেশি স্কুলে যাইনি। কিন্তু স্যরের কাছে পড়লে মনে হয় যেন আমরা স্কুলেই পড়াশোনা করছি। এখানে পড়তে খুব ভালো লাগছে।'