কৃষ্ণেন্দু অধিকারী ও সমীরণ পাল, কলকাতা: ভুল বোঝাবুঝিতে দল ছেড়েছিলেন। এখন আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন। রবিবার তৃণমূলে (TMC) নিজের প্রত্যাবর্তনকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করতে শোনা গিয়েছিল ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহকে (Arjun Singh)। আলিঙ্গন করে তাঁকে বুকে টেনে নিয়েছেন খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। তা নিয়ে প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে কেউ মুখ না খুললেন, বিষয়টি যে একেবারেই ভাল লাগেনি তাঁর, কোনও রকম রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিলেন অভিনেতা তথা তৃণমূল বিধায়ক চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী (Chiranjeet Chakraborty)। তাঁর মতে, দলবদল একটি রোগ। তা সারাতে কড়া ডোজের ওষুধের সুপারিশ করলেন তিনি। 

Continues below advertisement

অর্জুনকে ফেরানোয় তীব্র অসন্তোষ চিরঞ্জিতের

রবিবার তৃণমূলে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে সম্বর্ধনা নিতেই এই মুহূর্তে ব্যস্ত অর্জুন। ৩০মে তাঁর গড়ে আভার সভা করতে যাচ্ছেন খোদ অভিষেক। তাই কার্যতই দম ফেলার ফুরসত নেই তাঁর হাতে। অর্জুনের সেই উৎসাহেই এ বার কার্যত চোনা ফেললেন তাঁরই দলের সতীর্থ চিরঞ্জিৎ। এবিপি আনন্দের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, "দেখলাম অর্জুন বলেছে, বিজেপি-র জন্য বাংলার উন্নয়ন আটকে রয়েছে। জাস্ট রিভার্স কথা বলেছে। দু'দিন আগেই বলছিল, তৃণমূলই উন্নয়ন আটকে রেখেছে। বিজেপি এলেই হয়ে যাবে। সত্যি বলছি, এই পরিবর্তনটা আমার হাস্যকর লেগেছে।"

Continues below advertisement

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলবদলের স্রোত ছিল তৃণমূল থেকে বিজেপির দিকে। কিন্তু বিপুল জন সমর্থন পেয়ে তৃণমূল জিতে আসার পর সেই স্রোত এখন বিপরীতমুখী। বিজেপি থেকে দলে দলে লোকজন তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। এমনকি তৃণমূল থকে বিজেপি-তে যাওয়া নেতারাও মানে মানে ফিরে আসছেন পুরনো দলে। সেই তালিকায় সব্যসাচী দত্ত, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বশেষ সংযোজন অর্জুনের মতো হেভিওয়েট নেতারা রয়েছেন।

তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের এ নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ না থাকলেও, বিষয়টি যে একেবারেই না পসন্দ তাঁর, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন অর্জুনেরই জেলার বিধায়ক চিরঞ্জিৎ। তাঁর কথায়, "আমার মনে হয়, লে অফ করে দেওয়া উচিত এক বছরের জন্য। কেউ যদি দলবদল করেন, তাঁকে মাঝে একটা ট্রানজিটরি ফেজে এক বছর অন্তত বসে থাকতে হবে। কোনও পদে তাঁকে নেওয়া যাবে না। এটা আমার সাজেশন। এটা হলে মনে হয়, হয়ত দলবদল এত তরান্বিত হবে না।" চিরঞ্জিতের এই মন্তব্য নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি অর্জুন। তাঁর কথায়, "এই প্রস্তাবটি চিরঞ্জিৎ সরাসরি দিদিমণির কাছে পাঠালেই পারতেন।"

আরও পড়ুন: Dilip Ghosh: সুকান্ত জমানায় বঙ্গ বিজেপি-তে নিস্ক্রিয় দিলীপ, দায়িত্ব বাড়ল বাংলার বাইরে

তবে শুধু অর্জুনই নন, বালিগঞ্জের নব নির্বাচিত বিধায়ক, বিজেপি-ত্যাগী বাবুল সুপ্রিয়কে (Babul Supriyo) নিয়েও নিজের অসন্তোষের কথা জানান চিরঞ্জিৎ। তাঁর দাবি, এতে দলের ক্ষতি বই লাভ হয়নি। দলবদল করা বাবুলকে প্রার্থী করে তৃণমূল মানুষের বিরাগভাজন হয়েছে বলে দাবি তাঁর। চিরঞ্জিতের বক্তব্য, "একটি জায়গায় উপনির্বাচন হল। সেখানে ভোটটা খুব কমে গেল। ৪১ শতাংশ হয়ে গেল। ভোটিংটাই কমে গেল। প্রচুর নোটা হয়ে গেল আর কী। তার মানে এটা পছন্দ করে না পাবলিক। যদিও জিতে গিয়েছে, মার্জিন কিন্তু বেশি হয়নি। যেখানে ৭০-৮০ হাজার ব্যবধান থাকত, সেটা  বোধহয় ২৪ হাারে এসে ঠেকেছে।"

দলবদলের প্রবণতাকে রোগ বলেই উল্লেখ করেছেন চিরঞ্জিৎ। যাঁরা দল ছাড়ছেন, তাঁরা যে নিজেদের রীতিমতো হিসেব কষে, নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখে একদল থেকে অন্য দলে নাম লেখাচ্ছেন, তা খোলাখুলিই জানান তারকা বিধায়ক। তাঁর কথায়, "পার্টি পাল্টেই আবার ভোটে দাঁড়িয়ে গেলাম। অর্থাৎ ওই শর্ত দিয়েই আমি দলবদল করেছি! যে আসনটি দেবে, তার জন্য করেছি! এই বিষয়টিকে আটকে দেওয়া উচিত। পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়া উচিত। যদি তা না-ও হয়, এক বছর লে অফ করে দেওয়া উচিত। বসিয়ে দেওয়া উচিত। তাতে রোগের প্রকোপটা কমবে। এটা তো রোগই।"

চিরঞ্জিৎ কি বিতর্ক উস্কে দিলেন!

এমনিতে সচরাচর রাজনৈতিক মন্তব্য করতে শোনা যায় না চিরঞ্জিৎকে। তাই অর্জুন এবং বাবুলকে নিয়ে তাঁর এই মন্তব্যে একরকম শোরগোলই পড়ে গিয়েছে দলের অন্দরে। এ যাবৎ অল্পবিস্তর আসন্তোষ প্রকাশ ছাড়া, শীর্ষ নেতৃত্বের বিরোধিতা করতে যায়নি সে ভাবে কাউকেই। কিন্তু অসন্তোষের আঁচ যে জমা হচ্ছিল, তা টের পাওয়া যাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। যে কারণে কলকাতায় তৃণমূলে যোগদান করতে এসেও তাজ বেঙ্গল হোটেলে ঠায় বসে থাকতে হয় অর্জুনকে। ক্যামাক স্ট্রিটে সেই সময় উত্তর ২৪ পরগনার নেতাদের অসন্তোষ সামাল দিতে ব্যস্ত অভিষেক। বরফ গলাতে শেষমেশ সমন্বয় বৈঠকে ডেকে পাঠানো হয় অর্জুনকেও। মান-অবিমানের পালা চুকিয়ে শেষমেশ যোগদান করানো হয় অর্জুনকে। তবে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে, গলায় উত্তরীয় পরিয়ে, হাতে জোড়াফুল পতাকা ধরিয়ে স্বাগত জানানোর পরিবর্তে, পুরোটাই হয় বন্ধ দরজার ভিতরে। পরে ছবি ছাড়া হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তৃণমূলে ফেরার পর ক্যামাক স্ট্রিট থেকে অর্জুন যখন সাংবাদিক বৈঠক করেন, সেই সময়ও তাঁর পাশে দেখা যায়নি অভিষেককে, অথচ দুপুর থেকে সেখানেই সবকিছু সামাল দিচ্ছিলেন তিনি।