কলকাতা: আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় ঘরে-বাইরে প্রশ্নের মুখে তৃণমূল। সেই আবহেই রাজ্যসভার সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিলেন জহর সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে সাংসদ পদ ছাড়লেন জহর। শুধু তৃণমূলের সাংসদ পদই নয় রাজনীতি থেকে সরে আসার ঘোষণাও করলেন জহর। (Jawhar Sircar Resignation)
আর জি করের ঘটনায় উত্তাল গোটা দেশ। লাগাতার প্রতিবাদ-আন্দোলন চলছে। এমনকি দলের অন্দর থেকেও কেউ কেউ কেউ মুখ খুলেছেন। সেই আবহেই এবার তৃণমূলের রাজ্যসভা সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিলেন জহর। রাজনীতি থেকেও নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন করছেন বলে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন তৃণমূলনেত্রীকে। যে কারণগুলি উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে আর জি করের ঘটনাও রয়েছে। (RG Kar Case)
ইস্তফার কারণ জানতে চাইলে এবিপি আনন্দকে দেওয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমি সব কারণ বুঝিয়ে দিয়েছি চিঠিতে। আর কিছু বলার নেই। এই চিঠির ভিত্তিতে যা বোঝার বুঝে নিন। আমি আর থাকতে পারছি না। সম্ভব নয়। আর জি করের ব্যাপারে যা হয়েছে, আমার মনে হয় একেবারেই ঠিক নয়।" চিঠি মমতাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যপালের চেয়ারম্যানের কাছেও পদত্যাগপত্র জমা দেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
জহর লিখেছেন, মমতার হাত ধরেই রাজনীতিতে আগমন তাঁর। সংসদে বিজেপি-র বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। একাধিক বিষয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। কিন্তু আর রাজনীতিতে থাকতে চান না তিনি। এর কয়েক দিন আগেই, আর জি কর কাণ্ডে সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ খুলেছিলেন জহর। কেন সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে আগে পদক্ষেপ করা হয়নি, প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। নিয়োগ দুর্নীতি মামলা ঘিরে যখন উত্তাল পরিস্থিতি, সেই সময়ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন জহর। সেই সময় দলের অন্দরে বিষয়টি নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়। এবার সরাসরি পদ ছেড়ে দিলেন।
দু'পাতার চিঠিতে জহর লিখেছেন, রাজ্যে যে দুর্নীতি চলছে, নেতাদের অন্য়ায় দেখে তিনি হতাশাগ্রস্ত। রাজ্য সরকার যে পরিস্থিতি সামলাতে পারছে না, তাও স্পষ্ট করে লিখেছেন জহর। তাঁর এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আর জি কর কাণ্ডে ঘরে-বাইরে প্রশ্নের মুখে পড়ছে তৃণমূল। দলের অভিজ্ঞ সাংসদ সুখেন্দুশেখরও প্রকাশ্যে অসন্তোষ উগরে দিয়েছেন। এবার সেই তালিকায় নয়া সংযোজন জহর।
জহর জানিয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার বা ডাক্তারদের মনোনীত পোস্টিং দেওয়া, উচ্চপদে বসানোকে মেনে নিতে পারেন না তিনি। একাধিক সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন জহর। সাফ জানিয়েছেন, এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের রাগের বহিঃপ্রকাশ যে দেখছি আমরা, তার মূল কারণ হল পছন্দের আমলা এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের পেশিশক্তির আস্ফালন। এত বছরের কর্মজীবনে সরকারের প্রতি এত ক্ষোভ এবং অনাস্থা দেখেননি বলে জানিয়েছেন জহর। তাঁর মতে, গোটা ঘটনায় সরকারের যে পদক্ষেপ করছে, যে বিবৃতি দিচ্ছে, তা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। আর জি করের ঘটনায় মমতার সক্রিয় হস্তক্ষেপ দাবি করেছিলেন, কিন্তু রাজ্যের সরকার যে পদক্ষেপ করছে, তা অতি সামান্য এবং অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে বেল মত জহরের।
আর জি করের ঘটনায় বিরোধীর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে যদিও মেনে নেন জহর। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন, মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রতিবাদ করছেন। রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে এই আন্দোলন প্রতিরোধ করা সমীচীন হবে না। যাঁরা রাজনীতি পছন্দ করেন না, রাজনীতিকদের ঢুকতে দিচ্ছেন না, বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছেন, সেই আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন জহর।
জহরের এই সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিজেপি-র রাজ্যসভা সাংসদ তথা মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "জহর সরকার একজন নরেন্দ্র মোদি বিরোধী মানুষ হিসেবেই পরিচিত। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ করেছেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য, কর্মদক্ষতা নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি। ওঁর মতো একজন ব্যক্তিত্ব রাজ্যসভা থেকে চলে গেলে, নিঃসন্দেহে ভারতীয় রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সর্বোপরি রাজ্যসভার জন্য ক্ষতির। আজ পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে দলের অন্দর থেকে কখনও সুখেন্দুশেখর বাস্তিল দুর্গের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কখনও কুণাল ঘোষ বলছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ট্যুইট রিট্যুইট করা হচ্ছে না, সরকারের কাজে দল মুখ দেখাতে পারছে না। আজ জহর সরকারের মতো কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী মানুষও এই সিদ্ধান্ত নিলেন। এখন রাজ্য সরকার যা করছে, তা অনেক আগে করলে ভাল হতো। এখন এই সরকারের সঙ্গে কেউ নেই। তৃণমূলের বিসর্জন ছাড়া আর উপায় নেই। দফা এক, দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ।"
কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, "এর কোনও প্রতিফলন হবে কি না, সন্দেহ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্লজ্জতা এতটাই প্রকট যে কোনও অনুভূতি তাদের স্পর্শ করে না। মুখ্যমন্ত্রীর একবারও মনে হল না, আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসার কথা। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিবাদের প্রতি সহমর্মিতা, সমর্থন প্রকাশ করে নিজেকে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি এবং শাসক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা দেখলাম না।" জহরের এই সিদ্ধান্তে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। যদিও তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, 'একজন ছেড়েছেন, আর একজনও ছাড়ুন। স্রোতের অনুকুলে তো কচুরিপানাও ভাসে, যদি উল্টোদিকে সাঁতার না পারেন, তাহলে মানুষ জন্ম বৃথা। যুদ্ধের সময় যারা পালায় বা গা বাঁচিয়ে চলে, ইতিহাস তাদের লজ্জার নজরে দেখে'।