কলকাতা : কথায় বলে ‘একাই একশো’। আজ ভোটের ফলপ্রকাশের পর সেই চিত্রই ফুটে উঠল। ১০৮টি পুরসভার ভোটে কার্যত 'সবুজ সুনামি' উঠল। একাই ১০২টি পুরসভা দখল করল তৃণমূল। রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের দাপটে মুছে গেল বিরোধীরা। ৩৩টা পুরসভা পুরোপুরি বিরোধীশূন্য। 


ঘটল কিছু চমকপ্রদ ফলাফলও। প্রায় চার দশক পর কাঁথিতে ব্যাকসিটে অধিকারী পরিবার। প্রায় তিন দশক পর বহরমপুর হাতছাড়া হল কংগ্রেসের। এরমধ্যেও অবশ্য নদিয়ার তাহেরপুর পুরসভা দখল করেছে বামেরা। সবাইকে চমকে দিয়ে দার্জিলিং পুরসভা জিতে নিয়েছে, মাত্র চার মাস আগে তৈরি হওয়া হামরো পার্টি। অর্জুন সিং, দিলীপ ঘোষ থেকে সুকান্ত মজুমদার... বিজেপির হেভিওয়েটদের গড়ে ধস নামিয়ে ফুটেছে ঘাসফুল।


ভোটের ফল বেরনো শুরু হতেই ইঙ্গিত মিলছিল। দিকে দিকে সবুজ আবির ওড়া যে সময়ের অপেক্ষা তার কার্যত আভাস মিলছিলই। সেইমতো ১০৮ পুরসভার মধ্যে ১০২ পুরসভাই জিতে নিল তৃণমূলের। অর্থাৎ যতগুলো পুরসভায় ভোট হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ পুরসভাই দখল করেছে তৃণমূল। কেবলমাত্র দু’টি পুরসভা গেছে বিরোধীদের হাতে। সবুজ ঝড়ের মধ্যেও নদিয়ার তাহেরপুর পুরসভায় জয়ের লাল নিশান উড়িয়েছে বামেরা। আর দার্জিলিং পুরসভায় জয়ী নতুন দল হামরো পার্টি। চারটি পুরসভা ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। 


১০৮ পুরসভার ২ হাজার ২৭৬টা ওয়ার্ডে ভোট হয়েছিল। তার মধ্যে ১ হাজার ৮৬২টা ওয়ার্ডই দখল করেছে তৃণমূল। বিজেপি ৬৫। কংগ্রেস ৫৮। এবং বামেরা ৫৫টা ওয়ার্ডে জিতেছে। অন্যান্যর ঝুলিতে গেছে ৯৮টা ওয়ার্ড।


১০৮টা পুরসভার  মধ্যে ৩৩টা পুরসভা একেবারে বিরোধীশূন্য। এছাড়া ৬টা পুরসভা এমন রয়েছে, যেখানে সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি শূন্য হয়ে গেছে। এই ৬টা পুরসভায় তৃণমূল এবং নির্দল ছাড়া কারও অস্তিত্ব নেই। 


কলকাতা পুরভোট এবং চার কর্পোরেশনের ভোটের পর, ১০৮ পুরসভাতেও গেরুয়া শিবির কার্যত মুছে গেছে। চার দশক পর অধিকারী-শূন্য হয়ে গেছে শুভেন্দু  অধিকারীর গড় কাঁথি পুরসভা। দিলীপ ঘোষের গড় খড়গপুর, অর্জুন সিংয়ের গড় ভাটপাড়া, সুকান্ত মজুমদারের গড় বালুরঘাটে জিতেছে তৃণমূল। 


শুধু তাই নয়, গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই, উত্তরবঙ্গ এবং মতুয়া-অধ্যুষিত এলাকায় প্রভাব বাড়িয়েছিল বিজেপি। বিধানসভা ভোটেও এসব এলাকা থেকে ভাল ভোট পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু, পুরভোটে বিজেপির ভরসার সেই দুই গড় বিজেপির হাতছাড়া হল। 


লোকসভা ভোটে উত্তরবঙ্গের ৮টা আসনের মধ্যে ৭টাতেই জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা। পাশাপাশি মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ এবং রানাঘাটও তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নেয় গেরুয়া শিবির। গতবছরের বিধানসভা ভোটেও উত্তরবঙ্গর ৫৬টা আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ৩০টায়। অন্যদিকে, মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁ ও রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ১২টা আসনে জয়ী হয় বিজেপি। কিন্তু, এবার পুরভোটে বিজেপির এই দুই গড়েই থাবা বসায় তৃণমূল। 


উত্তরবঙ্গের ১৯টা পুরসভায় জয়জয়কার তৃণমূলের। একটা পুরসভাতেও জেতেনি বিজেপি। এই ১৯টা পুরসভার মধ্যে বিজেপি মাত্র ১২টা ওয়ার্ডে জিতেছে। বামেরা জিতেছে ৬টা ওয়ার্ডে। 


পুরভোটে মতুয়া অধ্যুষিত নদিয়ার ১০টা পুরসভার মধ্যে বিজেপি একটাতেও জিততে পারেনি। প্রাপ্ত ওয়ার্ডের নিরিখে তারা বামেদেরও পিছনে। বামেরা যেখানে ৮টা ওয়ার্ডে জিতেছে, সেখানে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৫টা ওয়ার্ড। মতুয়া অধ্যুষিত উত্তর ২৪ পরগনার ২৫টা পুরসভার মধ্যেও বিজেপি কোনওটায় জেতেনি। এখানেও প্রাপ্ত ওয়ার্ডের নিরিখে তারা বামেদের পিছনে। বামেরা ১৬টা ওয়ার্ডে জিতেছে। বিজেপি এবং কংগ্রেস পেয়েছে ৪টে করে ওয়ার্ড। 


তিন দশক পর অধীর চৌধুরীর গড় বহরমপুরের পুরসভাও ছিনিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। আজ অবধি কখনও না জেতা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর মজিলপুর পুরসভাতেও এবার প্রথম জিতেছে তৃণমূল।


এদিকে রাজ্যের ৪টি পুরসভায় ভোটের ফল ত্রিশঙ্কু। এই তালিকায় আছে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, পুরুলিয়ার ঝালদা এবং হুগলির চাঁপদানি। ৪ পুরসভাতেই বোর্ড গড়ার অঙ্কে পৌঁছতে প্রয়োজন অন্যের সমর্থন। সেক্ষেত্রে কি বহিষ্কৃত নির্দল প্রার্থীদের সমর্থন নেবে শাসক দল? তুঙ্গে জল্পনা। উত্তর মিলব শীঘ্রই।