স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী
আমরা কি আর বইতে পারি? 
এও কি একটা শাস্তি নয়? 
কষ্ট হয়, কষ্ট হয়!


শিক্ষার নামে ছোট্ট শিশুদের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন কবীর সুমন। প্রায় দু'দশক পর এবার তার সুরাহা হতে চলেছে। দেশের প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পড়ুয়াদের জন্য 'ব্যাগমুক্ত দিন' চালুর নির্দেশিকা জারি হল এতদিনে। কেন্দ্রের নির্দেশ মতো ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (NCERT)-এর তরফে নির্দেশিকা জারি করে আপাতত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ১০টি 'ব্যাগমুক্ত দিন' চালুর নির্দেশিকা জারি করল। (Bagless Days)


সোমবার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়াদের জন্য 'ব্যাগমুক্ত দিনে'র নির্দেশিকা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক। শিক্ষাকে আনন্দদায়ক, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যম এবং দুশ্চিন্তামুক্ত করে তুলতেই এমন পদক্ষেপ বলে জানানো হয়। এর পরই নির্দেশিকা জারি করে NCERT. ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পড়ুয়াদের জন্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। হাতেকলমে কাষ্ঠশিল্প মৃৎশিল্প, বাগান পরিচর্যা-সহ অন্য শিল্পকলা এবং কারিগরি শিক্ষার আয়োজন করতে হবে স্কুলগুলিতে। গড়ে ৬ ঘণ্টা করে ধরলে, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং পড়ুয়ারা বছরে ১০০০ ঘণ্টা স্কুলে অতিবাহিত করেন। সেই অনুযায়ী, বছরের ১০ দিন, অর্থাৎ ৬০ ঘণ্টা অন্য কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ অনুযায়ীই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়েছে। (Bagless Days Guidelines)


নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, শিশুদের কর্মজগতের জন্য প্রস্তুত করে তোলা প্রয়োজন, যার জন্য কর্মশিক্ষার নীতি গ্রহণ করতে হবে। কর্মজগতের জটিলতা বাড়লেও, নমনীয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখেই পড়ুয়াদের সমৃদ্ধ করে তোলা যেতে পারে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য 'ব্যাগমুক্ত' দিন অত্যন্ত জরুরি, যা আগামী দিনে দৈনন্দিন জীবনকেও প্রভাবিত করবে। এতে পড়ুয়াদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়বে। অনুশীলনের মাধ্যমে শেখাও সহজ হয়ে উঠবে তাদের জন্য। পাশাপাশি, সমাজ সংসারের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং নির্ভরশীলতার বিষয়েও ওয়াকিবহাল হয়ে উঠবে তারা। হাতেকলমে শেখার সুযোগ পেলে পড়ুয়াদের মধ্যে শ্রমের মর্যাদা বাড়বে তাদের কাছে।




ছবি: Getty.


সরকারি নির্দেশিকায় 'ব্যাগমুক্ত দিন'-এর কার্যক্রমকে তিনটি বিষয়ে ভাগ করা হয়েছে, 'বিজ্ঞান, পরিবেশ ও প্রযুক্তি', 'সরকারি দফতর, স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসা', এবং 'শিল্প, সংস্কৃতি বও ইতিহাস'।  'বিজ্ঞান, পরিবেশ ও প্রযুক্তি'র মধ্যে পড়ছে গাছপালা, পশুপাখি, মাটি, জল, সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস প্লান্ট, যন্ত্রমেধা, ডেটা সায়েন্স, রোবোটিক্স, সাইবার সিকিওরিটি, ড্রোন ট্রেনিং, বর্জ্য পৃথকীকরণ। 'সরকারি দফতর, স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসা'র মধ্যে পড়ছে পঞ্চায়েত অফিস, হাসপাতাল, ডাকঘর, ব্যাঙ্ক, ডেয়ারি ফার্ম, নির্মাণশিল্প, সশরীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণও পড়ছে এর মধ্যেই। 'শিল্প, সংস্কৃতি বও ইতিহাস'-এর মধ্যে রাখা হয়েছে পুতুলনাচ, নাচ, নাটক, ডুডলিং-সহ আরও অন্য বিষয়বস্তু। বইমেলা যাওয়া, 'স্ট্যাচু অফ ইউনিটি', সাঁচীর স্তূপের মতো জাতীয় সৌধগুলিকে কাছ থেকে দেখা, তার ইতিহাস জানা। 


বছরের যে কোনও সময়েই 'ব্যাগমুক্ত দিন' নীতি গ্রহণ করতে পারবে স্কুলগুলি। তবে টানা ১০দিনের পরিবর্তে দুই বা তিনটি স্লটে ওই ১০দিনের কর্মসূচি ভাগ করতে বলা হয়েছে, যাতে ইন্টার্ন হিসেবে হাতেকলমে পেশাদারদের থেকে কাজ শিখতে পারে পড়ুয়ারা। স্কুলের মধ্যে এবং বাইরে গিয়ে হাতে-কলমে শেখার সুযোগ মিলবে। সবজি বাজারে যাওয়া হোক বা পশুপালন, অথবা ঘুড়ি তৈরি, বিষয় যা-ই হোক, হাতেকলমে শেখার পর রিপোর্টও তৈরি করতে হবে পড়ুয়াদের। 


পড়ুয়াদের ব্যাগের ওজন বেঁধে দিতে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করেছে কর্নাটক। সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ১.৫-২ কেজি, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য ২-৩ কেজি, ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণির জন্য ৪-৪ কেজি, নবম ও দশম শ্রেণির জন্য ব্যাগের ওজন ৪-৫ কেজি পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হয়। মধ্যপ্রদেশ ও কেরলে সপ্তাহের একটি দিন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য 'ব্যাগমুক্ত' রাখার ঘোষণা হয়। এবার কেন্দ্রের তরফে গোটা দেশে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য বছরে ১০টি 'ব্যাগমুক্ত দিন' বরাদ্দ করার নির্দেশ এল।


পড়ুয়াদের ব্যাগের ওজন কমানো নিয়ে আলোচনায় তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়টিকতে এগিয়ে রাখা হয়েছিল। কারণ সমীক্ষায় দেকা যায়, ভারী ব্যাগ বইতে গিয়ে ছোট বয়স থেকেই পিঠের যন্ত্রণা, কাঁধের যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করেছে বহু পড়ুয়া। চিকিৎসকরাও সেই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জানান, প্রতি সপ্তাহেই এমন ছেলেমেয়েরা তাঁদের কাছে আসে, ভারী ব্যাগ বয়ে যাদের ঘাড়ে, পিঠে ব্যথা হয়েছে। অত্যধিক ভারী ব্যাগ বইতে গিয়ে মেরুদণ্ডের আকারও পাল্টে যায়, পেশীও আঘাতপ্রাপ্ত হয় বলে উঠে আসে। এমনকি দীর্ঘদিন ভারী ব্যাগ বওয়ার দরুণ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতাও শরীরে দানা বাঁধে বলে জানান চিকিৎসকরা। পড়ুয়াদের পিঠের ভার লাঘবের ক্ষেত্রে সেই সমস্ত বিষয়কে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।


যদিও বছরে ১০টি 'ব্যাগমুক্ত দিনে'র সুফল এবং কুফল, দুইই রয়েছে বলে মত শিক্ষাবিদদের একাংশের। তাঁদের মতে, এতে শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার যে চল, তাতে কিছুটা রাশ টানা যাবে। হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পাবে পড়ুয়ারা। দক্ষতা, সৃজনশীলতাবৃদ্ধির সহায়ক হবে এই নীতি। রোজগার একঘেয়েমিও কাটবে তাদের।


কিন্তু, এই কার্যক্রমে আবহওয়া মূল বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মন অনেকের। তাঁদের মতে, বছরের একটা দীর্ঘ সময় ধরে তাপপ্রবাহ চলছে ইদানীং। বর্ষাকালে আজকাল বজ্রপাতের প্রকোপ বেড়েছে। সেক্ষেত্রে পড়ুয়াদের বাইরে গিয়ে হাতেকলমে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি, কারিগরি কাজ শেখার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জল, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পড়ুয়ারা কী করে স্কুলে আনবে, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। যে কারিগরি শিক্ষার কথা বলছে কেন্দ্র, তার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি থাকা তো দূর, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই বিষয়বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় বলে মনে করছেন সমালোচকরা। বাইরে নিয়ে যাওয়া, বাড়ি যাওয়ার জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা কে করবে, সব পরিবারে আদৌ সাধ্য হবে কি না, উঠছে সেই প্রশ্নও। তাই উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ছাড়াই এই নীতি কার্যকর করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ।


আরও পড়ুন: WBCS Mains 2023: প্রিলিমসের পর এবার চূড়ান্ত ধাপ- এই দিন থেকে শুরু হবে WBCS মেনস পরীক্ষা


Education Loan Information:

Calculate Education Loan EMI