দার্জিলিং: কড়া নেড়েছে লোকসভা ভোট ( Loksabha Election 2024 )! ২৬ এপ্রিল দার্জিলিং, রায়গঞ্জ, বালুরঘাটে ভোটগ্রহণ। ভোটের হাওয়ায় সরগরম দার্জিলিং ( Darjeeling )। ভোটের হাওয়ায় গরম পাহাড়। কিন্তু শৈল শহরের সেই স্নিগ্ধতায় কোনও ছেদ পড়েনি। আবহাওয়ার মেজাজ বিগড়ে না গেলে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখের সামনে ধবধবে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নিরিখে উত্তরবঙ্গের ৮টি আসনের মধ্যে ৭টিতেই উড়েছিল বিজেপির পতাকা। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র গত ১৫ বছর বিজেপির দখলে। ২০০৯ সালে দার্জিলিং থেকে বিজেপি প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন আদতে রাজস্থানের বাসিন্দা যশবন্ত সিং। তারপর ২০১৪ সালে পাহাড় থেকে সুরেন্দ্র সিং অহলুওয়ালিয়াকে প্রার্থী করে বিজেপি। ২০১৯ এ জয় এনে দেন রাজু বিস্ত। মণিপুরের সেনাপতি জেলায় জন্ম রাজুর। বড়ও হয়েছেন সেখানে। শিল্পপতি রাজু বিজেপিতে যোগ দিয়েই সাংসদ হন। দলের জাতীয় মুখপাত্র হন। ২০২১ সালে তাঁকে বিজেপি যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও করা হয়। আর এবারের লোকসভা ভোটে দার্জিলিং-এ বিদায়ী সাংসদ রাজু বিস্তকেই ফের প্রার্থী করেছে বিজেপি। এখানে প্রাক্তন আমলা গোপাল লামাকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। সুকৌশলে তারা ভূমিপু্ত্র আবেগকেই উস্কে দিতে চাইছে। রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও, দার্জিলিং আসনে কখনও জিততে পারেনি তৃণমূল। অন্যদিকে দার্জিলিং লোকসভায় প্রার্থী ঘোষণা করেনি কংগ্রেস নেতৃত্ব। দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কংগ্রেস নেতা বিনয় তামাং। মঙ্গলবার বিবৃতি প্রকাশ করে এআইসিসির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এখন দেখার বিষয়, লোকসভা ভোটে পাহাড় কোনও চমক দেখায় কি না।
- ২০১৪-র লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী এস এস অহলুওয়ালিয়া, ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ২৩৯ ভোটে হারান তৃণমূল প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়াকে।
- ২০১৯ সালে রাজু বিস্ত চার লাখেরও বেশি ভোটে জয় পান। গোর্খা সম্প্রদায়ের হওয়াতেই রাজুকে পাহাড় নিজের করে নেয় বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা।
এক নজরে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিংয়ের ফল
ক্রমাঙ্ক ব়্যাঙ্ক প্রার্থীর নাম প্রাপ্ত ভোট ভোট
শতাংশ %রাজনৈতিক দলের নাম ১ ১ রাজু বিস্ত ৭৫০,০৬৭ ৫৯.২% বিজেপি ২ ২ অমর সিং রাই ৩৩৬,৬২৪ ২৬.৬% তৃণমূল কংগ্রেস ৩ ৩ শঙ্কর মালাকার ৬৫,১৮৬ ৫.১% ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ৪ ৪ সমন পাঠক ৫০,৫২৪ ৪.০% সিপিআইএম - নির্বাচকঃ ১৫,১৯,৫৩১ জন
- পুরুষ নির্বাচকঃ ৭,৫৩,৫১৩ জন
- মহিলা নির্বাচকঃ ৭,৬৫,৯৮১ জন
- মোট ভোট হয়েছে: ১২,৬৭,২৭০ (৮৪.১%)
- বৈধ ভোট: ১২,৫৬,৬৪৫ (৮২.৭%)
- মার্জিন: ৪১৩,৪৪৩ (৩২.৬%)
- NOTA ভোট: ১০৬২৫ (0.৭%)
এক নজরে ২০১৪ র লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিংয়ের ফল
ক্রমাঙ্ক | ব়্যাঙ্ক | প্রার্থীর নাম | প্রাপ্ত ভোট | ভোট শতাংশ % |
রাজনৈতিক দলের নাম |
---|---|---|---|---|---|
১ | ১ | এস এস আলুওয়ালিয়া | ৪৮৮,২৫৭ | ৪২.৮% | বিজেপি |
২ | ২ | বাই চুং ভুটিয়া | ২৯১০১৮ | ২৫.৫% | তৃণমূল কংগ্রেস |
৩ | ৩ | সমন পাঠক | ১৬৭,১৮৬ | ১৪.৬% | ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস |
৪ | ৪ | সুজয় ঘটক | ৯০,০৭৬ | ৭.৯% | সিপিআইএম |
- নির্বাচকঃ ১৪,৩৭,১২৬ জন
- পুরুষ নির্বাচকঃ ৭,৩৭,১৮৪ জন
- মহিলা নির্বাচকঃ ৬,৯৯,৯৪২ জন
- মোট ভোট হয়েছে: ১১,৪২,০০৯ (৭৯.৫%)
- বৈধ ভোট: ১১,২৩,৯৬৪ (৭৮.২%)
- মোট পুরুষ ভোটার: 5,৮৭,৬৭৮ জন
- মহিলা ভোটারঃ ৫,৫৪,৩৩১ জন
- মার্জিন: ১৯৭,২৩৯ (১৭.৩%)
- NOTA ভোট: ১৮,০৪৫ (১.৩%)
সূত্র : https://www.indiavotes.com/
২০২১ এর বিধানসভা ভোটে দার্জিলিংয়ের ফল
২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনেও এই আসনের অন্তর্গত সাতের মধ্যে পাঁচটি আসনে জয় পায় বিজেপি। ৭ টি আসন হল - কালিম্পং, দার্জিলিং, কার্শিয়ং,মাটিগাড়া, শিলিগুড়ি, ফাঁসিদেওয়া, চোপড়া। কালিম্পং বিধানসভায় বিধায়ক বিজিপিএম-এর। আর চোপড়ায় জয় পায় তৃণমূল। পাহাড়ের সঙ্গে সমতলও দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের অংশ। তাই সেদিকেও বাড়তি নজর সব দলের।
এ বছর দার্জিলিং কেন্দ্র কেন শিরোনামে
লোকসভা ভোটে দার্জিলিঙে বিজেপি প্রার্থী ঘোষণা করার পরই বিদ্রোহী হয়েছেন দলীয় বিধায়ক। নির্দলের হয়ে লড়বেন বলে সাফ জানিয়ে দিলেন কার্শিয়ঙের বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা । ফের তুলে আনলেন পৃথক রাজ্যের প্রসঙ্গ, যা পাহাড়ের ভোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গত ১৫ বছর ধরে।দার্জিলিঙে ভোট মানেই আরও একবার পৃথক রাজ্যের জিগির। বিজেপি বরাবরই BJP বরাবরই পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি পূরণে রাজনৈতিক সমাধান বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এই ইস্যুটি নিয়ে ভোটে জেতার পর আর কথা হয় না, অভিযোগ পাহাড়বাসীদের একাংশের। তার উপর এবার তাদের ক্ষোভ, ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করা হল না কেন? বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তিনি। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র গত ১৫ বছর ধরে গেরুয়া শিবিরেই আস্থা রেখেছে। কিন্তু এবার ভূমিপুত্র ইস্যু কি বিজেপির জয়ের পথে কাঁটা হয়ে উঠতে পারে ? এটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রার্থী ঘোষণার আগে থেকেই যদিও এই ইস্যুতে সরব হয়েছেন বিষ্ণুপ্রসাদ। তিনি স্পষ্টতই বলে দেন, পাহাড়ের বাসিন্দাকে প্রার্থী না করলে বিজেপিতে থেকেই নির্দল হয়ে লড়ব, দল ব্যবস্থা নিলে দেখা যাবে ! যদিও তাঁর হুঙ্কারকে পার্টির হাইকমান্ড যে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে তেমনটা বোঝা যাচ্ছে না রাজ্য সভাপতির কথায়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এখন পাহাড়ি রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব স্থাপন করেছেন প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার সভাপতি অনীত থাপা। অনেকেরই ধারণা পাহাড়ি রাজনীতিতে এই মুহূর্তে বিমল গুরুংয়ের গুরুত্ব কমেছে। জিটিএ ভোট বা পুরভোটেও তেমন প্রভআব দেখাতে পারেনি বিমল গুরুংয়ের দল। অনীতের প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা এই দুটি ভোটেই খাতা খুলেছে। পাহাড়ে তৃণমূলও প্রথম জয়ের মুখ দেখেছে প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার সৌজন্যেই। তবে বিজেপির ধারণা এই বিষয়গুলি লোকসভা ভোটে কোনও ফ্যাক্টর হবে না। বিমল গুরুংয়েই ভরসা করবে পাহাড়। আর এখন বিমল আর বিজেপি চলছে হাত ধরাধরি করেই।
পাহাড়ের রাজনীতি ও তৃণমূল
রাজ্যে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার আগেই পাহাড়ে শান্তির বাতাবরণ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর জিটিএ চুক্তি করেন তিনি ৷ মোর্চার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সুসম্পর্কের জেরে দীর্ঘদিন পর ২০১১-য় পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসে ৷ তারপরের ৩ বছরে কখনও সমঝোতা, কখনও সংঘর্ষ-এই পথেই চলেছিল মোর্চার সঙ্গে তৃণমূল সরকারের সম্পর্ক৷ জিটিএ নির্বাচনে একসময়ে মোর্চার জন্য প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেয় তৃণমূল৷ ২০১৪ র লোকসভা ভোটের আগেই সেই সুসম্পর্ক অতীত হয়ে যায় ৷ তৃণমূল-মোর্চা সম্মুখ সমরে নামে। বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে মোর্চা একাধিপত্য বজায় রাখার লড়াই চালায়। ক্ষমতায় আসার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে সুপ্রভাব তৈরি করলেও লোকসভা ভোটবাক্সে সেই প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল। লোকসভা ভোটে বিজেপিই এগিয়ে থেকেছে পাহাড়ে।
চা বাগান ও রাজনীতি
দার্জিলিং মানেই একটি কুঁড়ি, দু’টি পাতা। সেখানে রাজনীতিতেও চা নিয়ে কথা চলে। দার্জিলিংয়ে চা শ্রমিকদের জন্য তাই বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য সরকারও। শুধুমাত্র দার্জিলিঙ নয়, কোচবিহার , কালিম্পং, আলিপুরদুয়ারে চা শ্রমিকদের জন্যও এই প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। যেমন চা-সুন্দরী। উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই চা-শিল্প। চা বাগানের কর্মীদের জন্যই চা সুন্দরী প্রকল্প। এই প্রকল্পর পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকদের নানা সুবিধা দেওয়ার জন্য। এই প্রকল্পের ঘোষণা করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রকল্পের আওতায় আছেন উত্তরবঙ্গের চা বাগানের প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার পরিবার। এঁদের বাড়ি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে রাজ্য। এই সুবিধা দেওয়া হয় রাজ্যের শ্রম বিভাগের তরফ থেকে। চা শ্রমিকদের বেশিরভাগই মহিলা এবং তপশিলি উপজাতির। তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি করাও হয়। পর্যটনের উন্নতির জন্যও দরাজ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আরও বেশি করে যাতে হোম স্টে গড়ে ওঠে তার জন্য সরকারি সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে।
এখন এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের মানুষের ভোট কোনদিকে যায়, সেদিকেই দেখার , তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৪ জন পর্যন্ত।
আরও পড়ুন :
দিলীপকে ঘিরে দুর্গাপুরে কর্মী-সমর্থকদের ঢল ! মঙ্গলের সকালেই 'চায়ে পে চর্চা'য় চ্যালেঞ্জ