কলকাতা: ঠোঁটকাটা বললেও কম হয়। যা মুখে আসে বলে দেন মুখের উপর। ফিল্টার করে কথা বলে ঠিক সয় না তাঁর, ফলে কখনও কখনও সীমাজ্ঞান থাকে না।  কিন্তু এত 'বদনাম' থাকা সত্ত্বেও দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) রাজনীতিক সত্তা নিয়ে এতদিন প্রশ্ন তোলার সাহস হয়নি কারও। এমনকি বিরোধী শিবিরের নেতানেত্রীরাও সংগঠক হিসেবে দিলীপের প্রশংসাই করে এসেছেন এযাবৎ। রাজ্য রাজনীতিতে সেই দিলীপই বর্তমানে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে। বাইরের কেউ নয়, নিজের দল বিজেপি-ই কোণঠাসা করতে করতে কার্যত খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল তাঁকে। বর্ধমান-দুর্গাপুরে হেরে গেলেন দিলীপ। কয়েকশো বা কয়েক হাজার নয়, ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫৬৪ ভোটে তাঁকে পরাজিত করলেন প্রাক্তন ক্রিকেটার, তৃণমূলের প্রার্থী কীর্তি আজাদ।


কোথাও যে একটা তাল কাটছে, তা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর পরই বোঝা গিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্বে ভর করে বিজেপি তিন থেকে ৭৭ আসনে উঠে এলেও, আচমকাই রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বিজেপি-কে। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সংগঠনে নামমাত্র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করে রাখা হয়। রাজ্য বিজেপি-তে দিলীপ বিরোধী গোষ্ঠীর চাপেই বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন বলে গুঞ্জন শোনা যায় সেই সময়। দিলীপ যদিও সেই সময়ও নীরবতাই বজায় রেখেছিলেন। মেনে নিয়েছিলেন দলের সিদ্ধান্ত।


কিন্তু এবারের লোকসভা নির্বাচনের আগে বড় খাঁড়া নেমে আসে দিলীপের উপর। ২০১৯ সালে যে মেদিনীপুর কেন্দ্র থেকে ৮৮ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন দিলীপ, সেই কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। দিলীপের তৈরি করে রাখা জমি দলের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের হাতে তুলে দেওয়া হয়। রাতারাতি দিলীপকে এনে ফেলা হয় অচেনা বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদিও মুখ খোলেননি দিলীপ, কিন্তু আক্ষেপের সুর স্পষ্ট শোনা গিয়েছিলেন তাঁর গলায়। সেই অবস্থাতেও অগ্নিমিত্রাকে দিলীপকে বলতে শোনা যায়, 'জমি তৈরি আছে, জিতে নাও'। 


এর পর থেকে বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে কার্যত পড়ে থেকেছেন দিলীপ। নিজস্ব কায়দায় প্রাতঃর্ভ্রমণের ফাঁকে চা-চক্র সারা থেকে বাজারঘাটে মানুষের সঙ্গে কথা বলা, কিছুই খামতি রাখেননি। কিন্তু কোথাও যে সব ঠিক নেই, তা প্রচারপর্বেই বোঝা গিয়েছিল। একই জায়গায় তাঁকে বার বার ঘোরানো হচ্ছে, কোনও ব্যবস্থাপনা নেই বলে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন তিনি। তাই মঙ্গলবার সকালে দিলীপের জয় নিয়ে যখন সংশয় দেখা দিতে শুরু করেছে, তাঁকে বলতে শোনা যায়, "কম সময়ে, হঠাৎ করে লড়তে হয়েছে। বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার মনে হয় চমক অপেক্ষা করছে।"


কিন্তু দিলীপের পরাজয়ের জন্য বিজেপি-র কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্বকেই দায়ী করছেন দলের একাংশ। যে দিলীপ একাহাতে রাজ্য়ে বিজেপি-কে তুলে এনে দাঁড় করিয়েছে, তাঁর প্রতি এমন কাম্য নয় বলে মনে করছেন অনেকেই। দিলীপের সঙ্গে একসময় বিজেপি-তে থাকা, বর্তমানে তৃণমূলের বিধায়ক বাবুল সুপ্রিয় তাই কটাক্ষের সুরে লিখেছেন, 'বাই বাই দিলুদা।  এবার কেন্দ্রে সরাসরি মন্ত্রী হবেন আপনি। যাওয়ার আগে এর পর আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে, সেই ঠিকানা দিয়ে যাবেন কিন্তু। অনেকেই আপনাকে খুঁজবে'।


সেই আটের দশকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘে যোগ দেন দিলীপ। জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটে গিয়েছে সঙ্ঘের কার্যকর্তা হিসেবে। ২০১৪ সালে প্রথম বার সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেন দিলীপ। RSS-এর থেকে কার্যত তাঁকে ধার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নামায় বিজেপি। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-র সম্পাদক নিয়োগ করা হয় তাঁকে। ২০১৫ সালে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে ভর করেই রাজ্যে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে বিজেপি। কিন্তু যেভাবে ক্রমশ কোণঠাসা করা হচ্ছিল দিলীপকে, তা বিজেপি-র অন্দরেই অনেকে ভাল ভাবে গ্রহণ করেননি।