কোচবিহার : উত্তরবঙ্গে শক্ত ঘাঁটি BJP-র । অন্তত, এই প্রতিবেদনের আলোচ্য কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্র (Cooch Behar Lok Sabha Constituency) তো বটেই ! কারণ, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ফলের নিরিখে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের ছ'টিতেই জয়লাভ করেছিল গেরুয়া শিবির। পরে অবশ্য দিনহাটা (Dinhata) বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নেন তৃণমূলের উদয়ন গুহ। অর্থাৎ, ৫-২ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখোমুখি হতে চলেছে BJP-TMC। শেষ বিধানসভা নির্বাচনে এখানে ফরওয়ার্ড ব্লক ১.৭%, সিপিএম ১.৬% ও কংগ্রেস ০.২% শতাংশ ভোট পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, সমঝোতা করে লড়লে এই তিন দল এখানে কতটা 'হালে পানি' পাবে তা বলবে সময়। যদিও সেই সম্ভাবনাও আপাতত 'জলে'। কারণ, জোট-জটিলতা বাড়িয়ে এই কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে কংগ্রেসও। এই কেন্দ্রে ইতিমধ্যেই প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে চার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। বিজেপি এখানে এবারেও প্রার্থী করেছে নিশীথ প্রামাণিককে (Nisith Pramanik)। অন্যদিকে, ২০২১-এ বিধানসভা ভোটে জয় ছিনিয়ে নেওয়া জগদীশচন্দ্র বর্মণ বাসুনিয়ার উপর ভরসা রেখেছে তৃণমূল। বামেদের তরফে ভোট লড়বেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নীতীশচন্দ্র রায়। পিয়া রায়চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস।
কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় কোন কোন বিধানসভা এলাকা ?
১. মাথাভাঙা |
২. কোচবিহার উত্তর |
৩. কোচবিহার দক্ষিণ |
৪. শীতলকুচি |
৫. সীতাই |
৬. দিনহাটা |
৭. নাটাবাড়ি |
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে উপরের ৭ কেন্দ্রে জয়ী কোন দল ?
বিধানসভা কেন্দ্র | বিধায়ক | রাজনৈতিক দল |
১. মাথাভাঙা (এসসি) | সুশীল বর্মণ | বিজেপি |
২. কোচবিহার উত্তর (এসসি) | সুকুমার রায় | বিজেপি |
৩. কোচবিহার দক্ষিণ | নিখিল রঞ্জন দে | বিজেপি |
৪. শীতলকুচি (এসসি) | বরেন চন্দ্র বর্মণ | বিজেপি |
৫. সীতাই(এসসি) | জগদীশচন্দ্র বর্মণ বাসুনিয়া | তৃণমূল |
৬. দিনহাটা | নিশীথ প্রামাণিক (উপনির্বাচনের পর উদয়ন গুহ) | বিজেপি (পরে এই কেন্দ্রে উপনির্বাচনে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী উদয়ন গুহ) |
৭. নাটাবাড়ি | মিহির গোস্বামী | বিজেপি |
শেষ ৩ লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ী কারা ?
২০০৯ | নৃপেন্দ্রনাথ রায় | ফরওয়ার্ড ব্লক |
২০১৪ | রেণুকা সিনহা | তৃণমূল কংগ্রেস |
২০১৯ | নিশীথ প্রামাণিক | বিজেপি |
কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য-
১. কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে শিক্ষার হার | ৬৫.৬৪% |
২. এসসি ভোটারের হার | ৪৮.৬% (২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী) |
৩. এসটি ভোটারের হার | ০.৫% (২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী) |
৪. মুসলিম ভোটারের হার | ২৬.৩% |
৫. গ্রামীণ এলাকায় ভোটার | ৯০% (২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী) |
৬. শহর এলাকার ভোটার | ১০ % (২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী) |
৭. ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই কেন্দ্রে মোটার ভোটার | ১৮১০৬৬০ |
৮. ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই কেন্দ্রে মোট বুথ ছিল | ২০১০ |
৯. ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল | ৮৩.৮% |
কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে কোন ধর্মে কত শতাংশ ভোটার ?
বৌদ্ধ | ০.০২% |
ক্রিশ্চান | ০.১৫% |
জৈন | ০.০৭% |
মুসলিম | ২৬.৩% |
এসসি | ৪৮.৬% |
এসটি | ০.৫% |
শিখ | ০.০২% |
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে প্রতিন্দ্বন্দ্বী করা মূল রাজনৈতিক দলগুলির ভোট শতাংশ-
বিজেপি | ৪৮.৪ % |
তৃণমূল | ৪৪.৯ % |
ফরওয়ার্ড ব্লক | ৩.১% |
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে এই লোকসভা কেন্দ্রে কোন দলের কত শতাংশ ভোট ?
কংগ্রেস | ০.২% |
বিজেপি | ৪৯.১% |
সিপিআই | ০% |
তৃণমূল | ৪৪.৩% |
সিপিএম | ১.৬% |
আরএসপি | ০% |
ফরওয়ার্ড ব্লক | ১.৭% |
এসইউসিআই | ০% |
GOJAM | ০% |
কোচবিহারের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট-
অমিত শাহ বঙ্গ বিজেপিকে ৩৫ আসনের টার্গেট বেঁধে দিলেও ভোটের মুখে বাংলায় এসে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন- জিততে হবে ৪২-এ ৪২। আর সেই লক্ষ্যে ঝাঁপাতে মরিয়া বঙ্গ বিজেপি শিবির। আর তা করতে গেলে আগেরবার জেতা আসনে জেতার পাশাপাশি পদ্ম ফুল ফোটাতে হবে বাকি আসনগুলিতেও। এই আবহে বিভিন্ন কেন্দ্রে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। কারণ, কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে রাজি নয়।
সম্প্রতি নজিরবিহীন ছবি ধরা পড়ে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম এলাকা দিনহাটায় ! একেবারে সম্মুখসমরে চলে আসেন রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই মন্ত্রী ! লোকসভা ভোটের আগে উদয়ন গুহ ও নিশীথ প্রামাণিকের বিবাদ ঘিরে কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে দিনহাটা। এর আগে পঞ্চায়েত ভোট ঘিরেও কম অশান্তি হয়নি দিনহাটায়। এছাড়াও একাধিক ইস্যু রয়েছে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে।
কোচবিহারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর রাজবংশী ভোট। এই জেলায় প্রায় ৩৪ শতাংশ রাজবংশী ভোটার রয়েছেন। পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবিতে বারবার সরব হয়েছেন উত্তরবঙ্গের একাধিক বিজেপি বিধায়ক। ২০২২ সালে বাংলা ভাগ ইস্যুতে যখন তোলপাড় হয় গোটা রাজ্য, তখন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য় করেছিলেন অনন্ত মহারাজ। কোচবিহারের রাজনৈতিক সমীকরণের ক্ষেত্রে, গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন বা GCPA’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অনন্ত রায়ের ভূমিকা অত্য়ন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, অসমে পৌঁছে যান অমিত শাহ। ২০২২-এর ভাইফোঁটার দিন গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অনন্ত রায়কে উপহার পাঠান মুখ্যমন্ত্রী। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে চিলা রায়ের ৫১২ তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনন্ত রায়কে। তারপর অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠায় বিজেপি। দেড় বছর কাটতে না কাটতে, বঙ্গ বিজেপির বিরুদ্ধে সম্প্রতি ক্ষোভ উগরে দেন তিনি। 'রাজ্য বিজেপি আমাকে ডাস্টবিনে রেখে দিয়েছে। কেউ কোনও যোগাযোগই রাখেন না। প্রার্থী বাছাই নিয়েও আলোচনা করা হয়নি', বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। কোচবিহারে লোকসভা ভোটের প্রার্থী ঘোষণা হতেই বেসুরো হন বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ।
অতীতে তৃণমূল কংগ্রেসে ছিলেন নিশীথ প্রামাণিক। পরে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তাঁকে কোচবিহার থেকে প্রার্থী করে দল। তৃণমূলের থেকে সেবার কোচবিহার আসনটি ছিনিয়ে নেয় গেরুয়া শিবির। '২৪-এও কোচবিহারে বিজেপির প্রার্থী তিনিই! কিন্তু এবার তাঁকে ২ লক্ষ ভোটে হারানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে তৃণমূল। 'ডাকাত প্রার্থী' বলে কটাক্ষ করেছেন তৃণমূলের জেলা নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। থেমে থাকেননি নিশীথ প্রামাণিকও। প্রচারে বেরিয়ে তাঁর গলাতেও শোনা গেছে হুঁশিয়ারি ! প্রার্থীপদ ঘোষণার পর সিতাইয়ে গিয়েছিলেন অমিত শাহর ডেপুটি। সেখানে নাম না করে নিশানা করেন সিতাইয়ের তৃণমূল বিধায়ক জগদীশ বর্মা বাসুনিয়াকে। তিনি বলেন, "একমাত্র বিধায়ক ছয় মাস নিজের বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। আপনাদের এই বিধানসভার বিধায়ক। কোথায় তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডারা ? মাইকের আওয়াজটা কানে নিশ্চয়ই যাচ্ছে। এখনও সময় আছে শুধরে যাও। নইলে কিন্তু বিপদে পড়তে হবে। ভারতীয় জনতা পার্টির যাঁরা কর্মী, আমরা ২০১৯-এর পরে বলেছিলাম, সংযত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আপনারা যে ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালিয়েছেন আমাদের কর্মীদের ওপরে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের রেজাল্টের পরে কিন্তু আমরা কর্মীদের উচ্ছ্বাসকে আটকে রাখতে পারব না। আপনারা সাবধান হয়ে যান।"
লোকসভা ভোটে কোচবিহার আসনে জগদীশ বর্মা বাসুনিয়াকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তাঁর লড়াই বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক ও ফরওয়ার্ড ব্লকের নীতীশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। রয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীও। গত মঙ্গলবার মন্দিরে পুজো দিয়ে, জনতাজনার্দনের কাছে ক্ষমা চেয়ে ভোটের প্রচারে নামেন কোচবিহারের তৃণমূলপ্রার্থী। কিছুটা সংযতভাবে প্রচারে ময়দানে এগিয়ে চলেছেন তিনি। কিন্তু মানুষের কাছে কেন ক্ষমা চাইলেন শাসক দলের প্রার্থী? তার উত্তরও দিয়েছেন তিনি। জগদীশ বর্মা বাসুনিয়া বলেন, "গীতায় ভবগান বলেছেন, তুমি যা কিছু কর, আমাকে স্মরণ করে করবে, আমাকে অর্পণ করবে, আমিই তোমাকে রক্ষা করব। মানুষ জীবনে চলার পথে অনেক কাজ আছে, অজান্তে আমাদের হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃতভাবে করি না কিন্তু অজান্তে হয়। আমরা যারা সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করি, তাদের এরকম অজান্তে অনেক ভুল হয়ে যায়। সেই ভুলের জন্য আমরা মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ক্ষমা চাওয়া একটা মহত্ব, নত মস্তকে ক্ষমা চাওয়া এটা কোনও দোষের নয়, এটা একটা মহত্ব।"
লোকসভা ভোটে কোচবিহার আসন ফিরে পেতে মরিয়া তৃণমূল। সেই লক্ষ্যে বিক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মীদের কাছে বিবেক ভোট চেয়েছেন তৃণমূল জেলা সভাপতি অভিজিৎ দে ভৌমিক। গত পরশু এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, 'একসময় যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা থেকে সিপিএমকে উৎখাত করেছে তৃণমূল, আজ বিজেপির সেই পুরনো কর্মীদের অবস্থা দেখলে কষ্ট হয়। দলে কোনও গুরুত্বই পাচ্ছেন না তাঁরা।' এই পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ বিজেপি কর্মীদের কাছে বিবেক ভোটের আবেদন জানিয়েছেন কোচবিহারের তৃণমূল জেলা সভাপতি। এভাবে ভোট চেয়ে লাভ হবে না, বিজেপি কর্মীরা তৃণমূলকে হারাতে বদ্ধপরিকর বলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে গেরুয়া শিবির।
পাশাপাশি রাজ্যে বাম-কংগ্রেস জোটে আরও জটিলতা বাড়িয়ে কোচবিহারেও প্রার্থী ঘোষণা করেছে কংগ্রেস। আগেই কোচবিহার কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা করে ফরওয়ার্ড ব্লক। কোচবিহারে নীতীশচন্দ্র রায়কে প্রার্থী করে ফরওয়ার্ড ব্লক। সেখানেই পিয়া রায়চৌধুরীকে প্রার্থী করল কংগ্রেস।
আরও পড়ুন ; উদয়ন - নিশীথের বেনজির ধস্তাধস্তি, ধুন্ধুমার দিনহাটায়, বনধের ডাক TMCর
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে