ঝিলম করঞ্জাই, মনোজ বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ও আশাবুল হোসেন: সুযোগ বুঝে কখনও এ দল-ও দল। কখনও পুরনো দলে মতের মিল না হলেই দলবদল (Party Switch)। কখনও এক দলের হয়ে জিতে পরে অন্য দলে যোগ। বাংলা রাজনীতিতে এমন ঘটনা আকছার ঘটছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনের (Lok Sabha Election Result 2204) ফলাফল বাংলার ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন তুলেছে। সাধারণ মানুষের কাছে দলবদলু নেতাদের গ্রহণযোগ্য়তা কি কমল? তাঁদের কী ভাল চোখে দেখছেন না ভোটাররা? লোকসভা নির্বাচনে তাপস রায়, অর্জুন সিংহ, মুকুটমণি অধিকারী, কৃষ্ণ কল্য়াণীদের পরাজয় সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
প্রাপ্তির আশায় শত্রুপক্ষে যেতেও কসুর করেননি তাঁরা। কিন্তু, দল টিকিট দিলেও, রাজধানীর বোর্ডিং পাস আর পাওয়া হল না এরাজ্য়ের ৫ জনের। এঁদের কেউ তৃণমূলের, কেউ আবার বিজেপি। তালিকায় রয়েছেন- অর্জুন সিং (Arjun Singh), তাপস রায় (Tapash Roy), কৃষ্ণ কল্য়াণী, বিশ্বজিৎ দাস, মুকুটমণি অধিকারী (Mukutmani Adhikari)।
ব্য়ারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে হেরে গিয়েছেন এবার বিজেপির হয়ে প্রার্থী হওয়া অর্জুন সিংহ। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ঠিক মুখে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে, বিজেপিতে চলে গেছিলেন অর্জুন সিংহ। বিজেপির টিকিটে লড়ে ব্যারাকপুর থেকে সাংসদ হন। আবার চব্বিশের ভোটের আগে, তৃণমূলের তরফে টিকিট না পেয়ে ফের বিজেপিতে ঘরওয়াপসি করেন ব্যারাকপুরের সাংসদ। দল পাল্টেই বিজেপির টিকিটে ব্য়ারাকপুর থেকেই প্রার্থী হন। কিন্তু এবার আর শিকে ছিঁড়ল না তাঁর। কিন্তু অর্জুন নয় এবার ব্য়ারাকপুর ভরসা করেছে পার্থকে। প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার ভোটে, অর্জুনকে হারিয়েছেন, ব্য়ারাকপুরের তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিক।
কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে পরাজিত বিজেপি প্রার্থী তাপস রায়। তৃণমূলের বহু পুরনো এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বরানগরের প্রাক্তন বিধায়ক ছিলেন। লোকসভা ভোটের আগে, তাঁর বাড়িতে ED-র তল্লাশির পরই আচমকা মন বদলে ফেলেন তাপস রায়। তিনি যোগ দেন বিজেপিতে। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করায় বিজেপি। কিন্তু সুদীপের কাছে, ৯২ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত হন তাপস রায়। রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রে হেরেছেন তৃণমূলের প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী। তাপস রায় বিজেপিতে যোগদানের পরদিনই তৃণমূলে যোগ দেন, রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রানাঘাট দক্ষিণ আসনে বিজেপির প্রতীকে জয়ী হন তিনি। সূত্রের খবর, এবারের লোকসভা ভোটে রানাঘাট আসন থেকে টিকিট না পেয়ে অসন্তুষ্ট হন মুকুটমণি অধিকারী। লোকসভা ভোটের ঠিক আগে যোগ দেন তৃণমূলে। রানাঘাট লোকসভা আসন থেকে ভোটে দাঁড়ান। কিন্তু বিজেপি প্রার্থী জগন্নাথ সরকারের কাছে, প্রায় ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ভোটে পরাজিত হন তৃণমূলের মুকুটমণি।
রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রে পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী কৃষ্ণ কল্য়াণী। একুশের বিধানসভা ভোটে, রায়গঞ্জ থেকে বিজেপির টিকিটে লড়ে ২০ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়ে প্রথমবার বিধায়ক হন কৃষ্ণ কল্য়াণী। কিন্তু ভোটে জেতার কয়েক মাস পর থেকেই, বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধ বাড়তে থাকে কৃষ্ণ কল্যাণীর। '২১-এরই অক্টোবর মাসে, যোগ দেন তৃণমূলে। এবারের লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জ আসনে কৃষ্ণ কল্য়াণীকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। কিন্তু বিজেপি প্রার্থী কার্তিকচন্দ্র পালের কাছে, ৬৮ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত হন কৃষ্ণ কল্য়াণী।
বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাস। ২০১৯ সালে দিল্লিতে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। ২০২১-এর ভোটে বিজেপির টিকিটে জেতেন তিনি। কিন্তু বিধানসভা ভোটের ঠিক পরপরই তৃণমূলে ফিরেছিলেন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। চব্বিশের লোকসভা ভোটে সেই বিশ্বজিৎকে প্রার্থী করে দল। কিন্তু, বিজেপির শান্তনু ঠাকুরের কাছে, ৭৩ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত হন তিনি।
কী বলছেন রাজনৈতিক নেতারা?
রাজ্য়সভার সাংসদ বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য বলেন, 'একটা মানুষ রাজনৈতিক অবস্থান বদল করেছেন। তৃণমূলের সংস্কৃতির সঙ্গে তাপস রায়ের সংস্কৃতি মিল খায় না। তিনি এসেছিলেন, দাঁড়িয়েছেন। দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন, আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সফল হননি। অর্জুন সিংহে এলাকায় কার্যত উপদ্রুত অঞ্চল। উনি কেন তৃণমূলে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন সেটা দেখতে হবে। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন জেতার।' তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, 'আপাতদৃষ্টিতে এটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর সঙ্গে ওই সিটে কোন বিন্যাস কাজ করছে সেটাও তথ্য এলে দেখা যাবে।'
তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা গেছে, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে আগে যারা শিবির বদলেছিলেন, তাঁদেররও অধিকাংশই ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বৈশালী ডালমিয়া, রথীন চক্রবর্তী থেকে, প্রবীর ঘোষাল- সকলেই। অধ্যাপক মহানন্দা কাঞ্জিলালের মতে, 'মানুষ যখন ভোট দেয় প্রথম যেটা প্রয়োজন, সেটা হল আস্থা। ভোটে জিতে দল বদল করলে মানুষের আস্থায় ধাক্কা দেয়।'
রয়েছে ব্যতিক্রমও:
তবে এর ব্য়তিক্রমও আছে। গত লোকসভা ভোটের আগে দলবদল করে, বিজেপিতে গিয়ে জিতে যান অর্জুন সিং। একুশে দলবদল করে বিজেপিতে গিয়ে, মুখ্য়মন্ত্রীকে পরাজিত করেন শুভেন্দু অধিকারী।
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।
আরও পড়ুন: মেদিনীপুর থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না প্রমাণিত: দিলীপ