কলকাতা : কসবা কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী। জিতবেন কেন ভাবছেন ? বামেরা ক্ষমতায় আসবে কি না ? নতুন মুখ ফোরফ্রন্টে আনার পরে বামেদের পালে হাওয়া ফিরবে কি ? খোলামেলা সাক্ষাৎকারে জানালেন এবিপি আনন্দের প্রতিনিধি উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়কে।
প্রশ্ন : কী মনে হচ্ছে কসবায় ?
উত্তর : কসবায় আমরা জিতব। গতবারও আমরা জিতে যেতাম। ৬টার মধ্যে ৫টা ওয়ার্ডে জেতার পরেও একটা ওয়ার্ডে গায়ের জোরে ভোট করিয়ে, টাকা ছড়িয়ে নানারকমভাবে আমাদের হারানো হয়েছে। যাতে সেটা এবার আর না করতে পারে তার জন্য যা যা করার আমরা এবার করেছি। সেটা মানুষ দেখতে পাবেন। আমার ধারণা জাভেদ খানও এটা জানেন, এবার আর উনি জিতবেন না।
প্রশ্ন : কী মনে করেন, কত শতাংশ মানুষ প্রার্থীকে দেখে ভোট দেয় ?
উত্তর : চেহারা দেখে নয়। তবে প্রার্থীর একটা বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে তো বটেই। শতাংশের বিচার করতে গেলে বলাটা কঠিন। তবে, আমার ধারণা পাঁচ থেকে সাত শতাংশ প্রভাব পড়ে। আমার কোথাও মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এই ট্রেন্ডটা বেশি। পশ্চিমবঙ্গে দলটা মানুষের কাছে অনেক বেশি।
প্রশ্ন : বিশ্বাস করেন, পশ্চিমবঙ্গে সেই ট্রেন্ড আছে, যেখানে সবকিছু সমস্যা বিবেচনা করে ভোট দেন ভোটাররা ?
উত্তর : আমরা আবেদন করছি, মানুষ যেন এগুলো ভেবেই ভোট দেন। এই সমস্যাগুলি তো দলের সমস্যা নয়। যিনি ভোট দেন, তাঁর সমস্যা। গ্যাসের দাম বাড়ল কী অন্য রাজ্যে কাজের জন্য যেতে হল - এইসব সমস্যা মানুষের সমস্যা। পাঁচ বছর অন্তর একটা সুযোগ আসে এগুলি পাল্টানোর। এগুলো ভেবে ভোট না দিলে মানুষই তো ভুগবেন।
প্রশ্ন : অনেক স্টারকে প্রার্থী করেছে বিজেপি, তৃণমূল । মুখের গুরুত্ব কি পশ্চিমবঙ্গে নেই ?
উত্তর : নিশ্চয়ই আছে। বাংলার রাজনীতিতে স্টার যদি বলো মীনাক্ষি মুখার্জির থেকে বড় কেউ নেই। যাঁরা সিনেমা করে নাম করেছেন, তাঁদের অ্যাচিভমেন্টকে সম্মান করি। কিন্তু, বিষয় হচ্ছে, কাল যদি আমার বাড়িতে উনুন না জ্বলে মিঠুন চক্রবর্তী, দেবশ্রীরা বাড়িতে রান্না করে দিয়ে যাবেন না। মীনাক্ষি পাশে থাকবে, সৃজন পাশে থাকবে। বাকিরা পাশে থাকবে। এটাও অন্যরকমের স্টারডম। অন্য দলের স্টারেরা মানুষের জন্য কাজ করতে শুটিং ছেড়ে চলে আসছেন, বলছেন মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। মানুষের জন্য কাজ তো সবাই করতে চান। যারা শ্রমজীবী ক্যান্টিন লকডাউনের মধ্যে চালিয়েছেন তাঁরাও মানুষের জন্য কাজ করতে চান। তফাৎ হল, যখন লকডাউন হয়েছিল তখন আমরা মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলাম আর ওরা বিধানসভা ভোটের সময় মানুষের জন্য কাজ করতে চাইছেন। ওরাও স্টার। এরাও স্টার। কোন স্টারডম মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করবে তা মানুষ বিচার করবেন।
প্রশ্ন : ৯১টি আসনে ভোট ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। কসবায় ভোট আর কদিন পরে। ক্ষমতায় সত্যিই আসতে পারবেন ?
উত্তর : নিশ্চয়ই। কার জেতা উচিত এটা ভেবে মানুষ যদি ভোট দেন, নিশ্চয়ই আমরা সরকার গড়ব। আমরা জিতলে, বিরোধী যারা, তাদের বাড়িতেও ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতে ভর্তুকি পাওয়া যাবে। সাড়ে পাঁচ লাখ শূন্যপদ রয়েছে আমাদের রাজ্যে। একমাত্র আমাদেরই এই ক্রেডিবিলিটি আছে যে আমরা বছর বছর টেট, SSC পরীক্ষা করাতে। দুর্নীতি ছাড়া নিয়োগ করাতে। আগের সরকার নিয়োগ করেনি কারণ তাদের পলিসিই হচ্ছে, চাকরি দেব না- ভাতা দেব। কাউকে তিরিশ হাজার টাকার চাকরি দিলে কী লাভ ? বড়জোর সেই পরিবার ভোট দেবে। তার বদলে ওই তিরিশ হাজার দু'হাজার-দু'হাজার করে ভাতা হিসেবে ভাগ করে দিই, তাহলে পনেরোটি পরিবারকে বোঝাতে পারব, দেখো তোমাদের দয়া করলাম। আমি না থাকলে কাল থেকে এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এই থিওরি অফ গভর্নেন্স কিন্তু দুর্নীতি নয়। দূর থেকে দুর্নীতি বলে মনে হতে পারে। দূর থেকে দেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অযোগ্যতা বলে মনে হতে পারে। হয়তো এটা ওনার যোগ্যতাই। ওনার পলিসি। ওনার থিওরি অফ গভর্নেন্স। চাকরি দিয়ে নয়। ভাতা দিয়ে অনেক বেশি মানুষকে আমার উপর নির্ভরশীল করে রাখব। সেটা করতে গিয়ে আজ পশ্চিমবাংলার এই অবস্থা।
প্রশ্ন : কেন মানুষ আপনাদের ভোট দেবেন ?
উত্তর : আমরা সাড়ে পাঁচ লক্ষ শূন্যপদে নিয়োগ করব। বিরোধী পরিবারের ছেলেমেয়েরাও চাকরি পাবে। মাটি কাটার কাজ করতে, মজুরের কাজ করতে রাজ্য ছেড়ে মানুষ বাইরে যাচ্ছে, এ আমরা কোনওদিন দেখেছিলাম ? ছোটো থেকে দেখেছি বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে মানুষ এখানে কাজ করতে এসেছে। মাটি কাটার কাজ করতে বাংলা থেকে মানুষ বিহারে গেছেন, লকডাউনের সময় এছবি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ শ্মশানে পরিণত হয়েছে। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা চাকরি না পেয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজ্যে যে চাকরি হচ্ছে বেসরকারি ক্ষেত্রে তার যা প্যাকেজ তা বাইরের রাজ্যের থেকে কম । তার কারণ চাকরির এখানে এত আকাল, কম্পানির মালিকেরা জানে, যা মাইনে তারা দেবে তাতেই এখানকার ছেলেমেয়েরা চাকরি করতে রাজি হবে। কারণ তাদের হাতে কোনও চয়েস নেই। গত ১০ বছরে সব তো দেখলাম, কিন্তু নতুন কারখানা উদ্বোধন হচ্ছে, সে ছবি কই ? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর দশ বছরে কারখানা উদ্বোধন করছেন ১০০টা ছবি দেখাতে পারি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ছবি দেখান।
প্রশ্ন : মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, আপনাদের দূরবীন দিয়ে দেখতে হবে। কসবায় দেওয়াল লিখনে সত্যিই তো দূরবীন দিয়ে দেখতে হবে !
উত্তর : রাতের বেলা লুকিয়ে পোস্টার খুলে দিচ্ছে। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ। চারটে দেওয়াল মুছে দিয়ে, পোস্টার ছিঁড়ে দিয়ে প্রচার আটকানো যাবে না। আমাদের হেলিকপ্টার নেই। আমরা মাটিতে পা রেখে হেঁটেছি বলেই, দশ বছরে এত আঘাত, এত সন্ত্রাস, এত আক্রমণ সত্ত্বেও CPM দলটা টিকে আছে। অন্য কোনও দল হলে এদ্দিন ইতিহাসের পাতায় নাম উঠে যেত। আমরা জাভেদ খানের মত কসবায় বেড়াতে আসি না। যাঁরা রাজনৈতিকভাবে আমাদের সমর্থন করেন না, তাঁরা জানেন আমার কথা। আমাদের কথা। ক্ষমতা না থেকেও যেভাবে আমরা মানুষের পাশে থেকেছি, ক্ষমতা থাকলে আরও বেশি থাকতে পারব।
প্রশ্ন : মীনাক্ষি মুখার্জিকে লড়তে হচ্ছে হেভিওয়েট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে। আপনার প্রতিপক্ষ অভিজ্ঞ জাভেদ খান । কী মনে হয় ?
উত্তর : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী কীসের ওজনে হেভিওয়েট ? মীনাক্ষি ঘুম কেড়ে নিয়েছে দু'জনের। আজ নন্দীগ্রাম নিয়ে যদি আলোচনা হয় মীনাক্ষির নাম ছাড়া আলোচনা করা যাচ্ছে না। এটা মীনাক্ষি অর্জন করেছে শারীরিক ওজনে নয়। কসবাতেও আমাদের নাম বাদ দিয়ে আলোচনা করা যায় না। জাভেদ খান গতবারেও হেভিওয়েট ছিলেন। আমি আজ যা গতবারেও ছিলাম। ছটার মধ্যে পাঁচটা ওয়ার্ডে ওনাকে হারিয়েছিলাম। কয়েকটা বুথে কীভাবে জিতেছেন, সে তো আমরা জানি। যারা কসবার মানুষ, আবেদন করছি, এটা আমার একার লড়াই নয়। সবার লড়াই।
প্রশ্ন : সত্যিই কি বামেরা, মোর্চা লড়াইয়ে আছে ?
উত্তর : লড়াইয়ে যদি না থাকতাম, সভা করতে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদিকে আমাদের আক্রমণ করতে হত না। আমাদের খুঁজে খুঁজে তারা আক্রমণ করছে। আমরা ভোটে হারার পরে কীভাবে মানুষের পাশে থেকেছি, তা মানুষ জানেন। পশ্চিমবঙ্গের মাটি আজ থেকে দু'বছর আগে যা ছিল আজ কিন্তু তা নেই।
প্রশ্ন : নতুন মুখের সাহায্যে সত্যিই কি নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারবে বামেরা ?
উত্তর : একটা প্রজন্ম আরেকটা প্রজন্মের হাতে ব্যাটন তুলে দেবে সেটাই স্বাভাবিক। সংকটের মধ্য়ে যে জেনারেশনটা মানুষের পাশে থাকল তাদের আরও বড় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এগিয়ে দেওয়া। যত তরুণ মুখকে নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে, এরা কেউ পিসি-ভাইপোর যোগ্যতায় এই জায়গায় আসেনি। কেউ কোনও নেতার ছেলেমেয়ে হওয়ার যোগ্যতায় এই জায়গায় আসেনি। প্রত্যেকে রাজনৈতিক লড়াইয়ে থাকছে। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদেরকে পার্টি আরও বড় দায়িত্ব দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে। এরাই পারবে বাংলাকে সুরক্ষিত রাখতে। এদের হাতেই বাংলা নিরাপদ।