আগামী ২৪ ডিসেম্বর মুক্তি পাচ্ছে পরিচালক অভিজিৎ সেনের 'টনিক' (Tonic)। এই ছবিতে দেব (Dev) ছাড়াও অভিনয় করতে দেখা যাবে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শকুন্তলা বড়ুয়াদের মতো শিল্পীদের। ছবি মুক্তির আগে বেশ উত্তেজিত টলিউড ইন্ডাস্ট্রির বর্ষীয়াণ এবং বর্ণময় চরিত্র পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Paran Bandyopadhyay)। 'টনিক' ছবিতে তিনি এমন সব দৃশ্যে অভিনয় করেছেন, যা দেখে তাক লেগে যাবে বাঙালির। তাই যেন রাফটিং শেষ করে বা প্যারাগ্লাইডিং শেষ করেই এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিলেন এবিপি লাইভকে। 


 


এবিপি লাইভ : 'টনিক' ছবিতে আপনার চরিত্রটা কেমন?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : একজন সাধারণ বয়স্ক বাবার চরিত্র।


এবিপি লাইভ : এই বয়সে রাফটিং করছেন। 'টনিক' ছবিতে এই সিকোয়েন্সটা কীভাবে এলো?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : আসলে এই ছবিতে আমার চরিত্রের নাম জলধর সেন। তা সেই জলধরের বয়স হয়েছে বলে তাঁর ছেলে সবসময় বাবার শরীরের দিকে খেয়াল রাখে। বাবার কীসে ঠাণ্ডা লাগবে। বাবার কীসে পেট খারাপ হবে। ছেলের তৈরি একটা অনুশাসন মেনে চলতে হয় বাবাকে। যেমন ধরো, ছেলের বিবাহবার্ষিকীটা হয়েছে বিদেশে। সেখানে সবাই সবকিছু ভাজাভুজি খাচ্ছে। আর বৃদ্ধ বাবা ঠাণ্ডায় বসে সব দেখছে। সে এসব খেতে পারছে না। তাঁর শরীরের কথা ভেবেই ছেলের মানা রয়েছে। এরপর বাবার বিবাহবার্ষিকী এলো। কিন্তু বিদেশে না হয়ে সেটা নাকি হবে বাড়ির ছাদে। আসলে মানুষ তো যত বুড়ো হয়, তত ছেলেমানুষ হয়ে যায়। সেই সূত্রেই বাবার অভিমানমিশ্রিত একটা জেদ চেপে যায়। বুড়ো বয়সে ছেলেমানুষির জেদ চাপলো। এরপর তাঁর বন্ধু একটা বুদ্ধি দিল। তখন বাবাও চাইলো নিজের বিবাহবার্ষিকীটা অন্যরকম হবে। সেখান থেকেই 'টনিক'-এর আবির্ভাব হল। 


এবিপি লাইভ : এই বয়সেও এসব অ্যাডভেঞ্চারের দৃশ্য কীভাবে করেছেন! 
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : পরিচালক অভিজিৎ সেনের প্রথম ছবি এটা। ওর স্ক্রিপ্ট পড়ে ভাল লাগলো। অভিজিৎ, দেবকে শোনালো। দেবেরও পছন্দ হল। জলধর সেনের চরিত্রটা আমারও পছন্দ হল। শুটিংয়ের সময় জানতে পারি, প্রযোজক-পরিচালক সকলেই চেয়েছিলেন এই চরিত্রটা আমিই অভিনয় করবো। যদিও ওরা যখন আমায় প্রস্তাব দেয়, তখন আমি দুটো দিন ভাবার সময় চেয়েছিলাম। কিন্তু, এর মাঝেই পরিচালক অভিজিৎ সেন আমার বাড়িতে এসে বললো, পরাণ দা কী ভাবছো? আমি বললাম, ওসব অ্যাডভেঞ্চারের কাজকর্ম আবার, আমায় করতে হবে নাকি! অভিজিৎ বললো, না-না। পরে শুটিং করতে গিয়ে বুঝলাম আসলে ছলনা ছিল। (মিষ্টি হাসতে-হাসতে)।


এবিপি লাইভ : 'টনিক' ছবিতে রাফটিংয়ের অভিজ্ঞতা যদি বলেন-
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : রাফটিংয়ের সময় যখন আমি শুটিংয়ে হাজির হলাম, দেখলাম জলের স্রোতও আছে বেশ। আমি তো দেখেই প্রথমে বললাম, না। আমি এসব পারবো না বাবা। তখন দেব এসে বললো, পারবে পরাণ দা। আমি বললাম, কতক্ষণ লাগবে? আমায় বড় সহজ করে জবাব দিল, ওই মিনিট পাঁচেক লাগবে। (ভাবটা এমন যেন ৫ মিনিট নয় ৫ সেকেণ্ড লাগবে)। কোনওরকমে শুটিং শুরু করলাম। কিন্তু মিনিট খানেক বাদেই যখন একটা বাঁক নিলাম, দেখি একটা পর্বতসমান ঢেউ এসে পড়লো। আমার তো তখন ভয়ও লাগছে খুব। কিন্তু ফেরার উপায় নেই। কী ঠাণ্ডা। তার উপর, একের পর এক স্রোত আসছে। আমি তার মধ্যেই অভিনয় করছি। সংলাপ বলছি। দূর থেকে টনিক উৎসাহ দিচ্ছে। এসব দেখেশুনে আমারও মনে জোর এলো। ভাবলাম, ফেরার থেকে শেষ করাই ভাল। তারপর মিনিট ২০ পর শেষ হল শুটিং। আমার ওই ভয়ের কষ্টটাই দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। এরপর তীরে উঠে ওদের উত্তম-মধ্যম দিলাম। (হাসতে-হাসতে)


এবিপি লাইভ : দেব কতটা সাহায্য করছিলেন সেই সময়? 
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : দেবের একটা দারুণ ক্ষমতা দেখলাম, মানুষকে মোটিভেট করার। যখনই একটু ভয় পাচ্ছি। ভাবছি, ধুত এটা করবো না। তখনই দেব এসে বলেছে, ঠিকই পরাণ দা। ওসব করার দরকার নেই। ওর কায়দাগুলো কিন্তু দারুণ। বুঝতে পারছি, অনেকটা সুতো ছেড়ে দিয়ে খেলছে। আমাকে বুঝিয়ে বলছে, ছাড়ো তো পরাণ দা। করতে হবে না। কী আর এমন হবে? বড়জোর পাঁচ-সাত লক্ষ টাকা যাবে। ওসব তুমি তুমি চিন্তা করো না। এবার ভাবো, পাঁচ-সাত লক্ষ টাকা নষ্ট হবে শুনে, কেউ কাজটা না করে পারে? এত দুষ্টু দেব। 


এবিপি লাইভ :  রাফটিং ছাড়া অন্য কোনও দৃশ্যে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে? 
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : হ্যাঁ, হয়েছে তো। বৃষ্টির একটা দৃশ্য ছিল। মানে ছবিতে আছে। সেটাও খুব কষ্টকর ছিল। একটা দৃশ্যে আছে, আমায় রাতে বাথটবে স্নান করতে হবে। পরিচালক অভিজিৎকে খুব বকেছি (স্নেহ/আদরের বকা)। পরে আবার নিজেই ভেবেছি, আমি তো গোড়াতেই না করতে পারতাম। তা তো করিনি। তাহলে এখন করবো না কেন? ব্যস, মনে জোর পেয়েছি। আর শট দিয়েছি। আর একটা কথা অবশ্যই বলবো, দেব এই ছবিতেও যেমন টনিকের কাজ করেছে। বাস্তবেও দেব কিন্তু, আমার জন্য টনিকেরই কাজ করেছে। দেবের বাস্তব চরিত্রটা দেখে অবাক হয়েছি। ও মানুষ হিসেবে বড্ড ভাল। আমার অনেক খেয়াল রেখেছে। খুব ভালবাসে আমায়। 


এবিপি লাইভ : 'টনিক' ছবিতে বোধহয় আপনাকে প্যারাগ্লাইডিং-ও করতে হয়েছে। 
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : সেটাও করেছি। বাপ রে বাপ। প্যারাগ্লাইডিং শুরু হল। আমি তো ভাসছি। দেখি আমার পাশে টনিকও ভাসছে। তখন মনের জোর বাড়ানোর জন্য ভাবছি ওই তো দেব পাশে আছে। ভয় পেয়ে আর লাভ কী! আমি তো তখন নিচে একবারও তাকাচ্ছি না। আর আমার ভেতরের পরাণ বলছে ফিরতে হলে আগে না করিসনি কেন? ফিরে না এসে এগিয়ে গিয়ে ওপারে যা। অগত্যা সেটাই করলাম মনের কথায়। আবারও বলবো দেবের কথা। এর আগে চাঁদের পাহাড় বা অন্যান্য ছবিতেও যেমন সবসময় আমাকে আগলে রেখেছে, এখানেও তেমনই গাইড করেছে আমায়। ওর মতো ছেলে না থাকলে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনওদিন এসব করতে পারতো না। যেগুলো আমি করেছি বলে মনে হচ্ছে, এগুলো দেবই আমায় দিয়ে করিয়েছে। 


এবিপি লাইভ : অনেকগুলো ছবি একসঙ্গে করলেন। দেবের সঙ্গে আপনার কেমিস্ট্রির রহস্য কী ?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : আসলে কী জানো, আমার মধ্যেও তো একটা দৌরাত্ম্য ছিল। খুব দুষ্টু ছিলাম আমিও। কিন্তু, এখন বয়স বেড়েছে। তাই সেগুলো মনের ভিতরে ঝিমিয়ে রয়েছে। মরে তো যাইনি। দেবের মধ্যে নিজের ছোটবেলাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম। তাই ও পাশে থাকাতেই ভিতরের সেই সুপ্ত দুরন্তপনাটা বেরিয়ে এসেছে। দেব ছাড়া দ্বিতীয়বার এগুলো আর কখনও করতে পারবো না। 


এবিপি লাইভ : 'টনিক' ছবিতে মনে থাকার মতো কোনও দৃশ্য?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : আছে তো। অনেকগুলো আছে। এই ছবিতেই দেবেরও একটা অতীত রয়েছে। ওদিকে আমার চরিত্র জলধর সেনের ছেলে খুব আতুতুতু করে বাবাকে আগলে রাখে। কিন্তু নিজের জীবনে সে সবই করছে। এই অসম অনুশাসনটাই বাবাকে পীড়া দিচ্ছে। আমার বেলায় এই আর তোমার বেলায় ওই? কিন্তু ওই বয়সে জীবন উপভোগ করাটা কতবড় হঠকারিতা, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। দুজনেই-দুজনকে ভালবাসে। তাসত্বেও এই সম্পর্কের টানাপোড়েন, দর্শকদের খুব ভাল লাগবে। সকলেই রিলেট করতে পারবে নিজের পরিবারের সঙ্গে। 'টনিক' ছবিটা সববয়সের সমস্ত দর্শকদের খুব ভাল লাগবে। 


এবিপি লাইভ : এই ছবিটা দর্শক কেন দেখতে যাবে?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : যদি অল্পবয়সীরা যায়, তাঁদের অ্যাডভেঞ্চারের দৃশ্যগুলো খুব ভাললাগবে। আর ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্কটা বুঝতে পারবে। এখানে কেউ খারাপ নন। দুজনেই দুজনকে ভালবাসে। তাসত্বেও সম্পর্কে যখন তিক্ততা তৈরি হয়, সেটা ভাবার। দর্শক বুঝতে পারবে। সব বয়সের দর্শকের জন্যই 'টনিক' শুধু উপভোগ্য নয়, ভাবাবে। 


এবিপি লাইভ : আপনার বয়স বেড়েছে অনেকটাই। এখন কতটা কাজ করেন সারাদিন?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় :  কমিয়ে দিয়েছি অনেকটাই। এখন সব কাজ করি না। খুব ভাল করে বাছাই করে, তবে করি। অনেক ছবিই বাতিল করে দিই। আমার আগে শর্ত থাকে, কোথায় শুটিং হবে? যদি দূরে বলে, তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে নাকচ করে দিই। এই জন্যই তো বম্বের ছবি করতে চাই না। এই তো সেদিন একজন পরিচালক বলছিলেন গোয়ায় আর আন্দামানে শুটিং হবে। আমি শুনেই বাতিল করে দিলাম। আরেকটি ক্ষেত্রে বলা হল শুটিং হবে কাশ্মীরে। আমি শুনেই না করে দিলাম। কলকাতায় বা কলকাতা থেকে এক দেড় ঘণ্টা দূরত্বের মধ্যেই এখন কাজ করি। এরপর দ্বিতীয় শর্ত হল, সংলাপ। যদি সংলাপ ভাল লাগে। মনে হয় একজন অভিনেতা হিসেবে এই সংলাপগুলো বলতে ভাল লাগবে, তখনই ছবিটা করার জন্য হ্যাঁ করি।  


এবিপি লাইভ : দিনে কতক্ষণ শুটিং করেন এখন?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : সবাইকে বলে নিই। ৬ ঘণ্টা থাকবো। ৫ ঘণ্টা কাজ করবো। ব্যস। 


এবিপি লাইভ : পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তব জীবনের টনিকটা কী?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : মানুষ। মানুষ হল আমার শিক্ষক, দেবতা। তাঁদের থেকে শিক্ষা নিয়েই আমার জীবনের সবকিছু। তাঁরা আমায় যে প্রশংসা করে, সেগুলোই আমার প্রেরণা। দেবতা যদি আমায় বলে ভাল হয়েছে, তখন আরও উৎসাহিত হয়ে আরও ভাল করতে ইচ্ছে করে। যতদিন পারবো, ততদিন মানুষকে নিজের কাজের মাধ্যমে ভালো লাগিয়ে যাবো।


এবিপি লাইভ : ২০২১ বছরটা কেমন গেল আপনার?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : বসে-বসেই গেল। চোখটা একটু সমস্যা করছে বলে, বইটা বেশি পড়তে পারলাম না। তবুও পড়লাম। নাটক তো করি এখনও। নাটক আর ছবিতে অভিনয় করে বছর কাটিয়ে দিলাম।  


এবিপি লাইভ : এখন করোনা পরবর্তী সময়ে শুটিংয়ের সময় নিয়ম-কানুন কতটা মানেন?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : মানি। তবে, আরও একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো, কাজের সময় না, সব নিয়ম মানা সম্ভব নয়। আর ওটাই কিন্তু ঠিক। ভয় পেলে, আতঙ্ক নিয়ে তো আর সুন্দর সংলাপ বলতে পারবো না। সংক্রমিত হয়ে গেলাম না তো? এসব ভাবতে-ভাবতে ভাল কাজ করা যায় না। আমি যে দেবতার পুজোয় বসেছি, তাই না? 


এবিপি লাইভ : ওমিক্রন আসছে। আবার যদি সিনেমাহল বন্ধ হয়?
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : আমার ভাবনাটা হচ্ছে যে, সারা বিশ্বজুড়ে মানুষকে যেন একটা রোগের ভয় দেখিয়ে রাখা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মানুষকে যেন তটস্থ করে রেখেছে। তখন মনে-মনে বলি, ধুর, যা হয় হবে। ভয়কে জয় করতেই হবে। 


এবিপি লাইভ : আগামী বছর নিয়ে কী ভাবছেন। 
পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় : আমি তো পথিক। চলতে থাকবো। এগিয়ে যেতে থাকবো। এখন তো বয়স হল। জীবনে অনেক কিছু দেখলাম। তাই এখন ভাল-মন্দ চিনতে পারি। ভালগুলো কাছের লোকদের সঙ্গে শেয়ার করি। মন্দকে এড়িয়ে চলি। এভাবেই আগামী দিনগুলোয় চলতে থাকবো। 


একদমই তাই পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এবিপি লাইভের পক্ষ থেকেও আপনার আসন্ন ছবি 'টনিক'-এর জন্য অনেক-অনেক শুভেচ্ছা। আগামী বছরের জন্যও। ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।


আরও পড়ুন - ABP Ananda Exclusive: তাঁর গানেই লিপ দিয়েছিলেন দিলীপ কুমার, 'সাগিনা'র জন্মদিনে স্মৃতিচারণ অনুপ ঘোষালের