কলকাতা: বেশ অনেকদিন হল ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছেন অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলা শর্মা। শরীরের জন্য ছেড়েছেন কাজও। এখন তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী প্রেমিক সব্যসাচী চৌধুরী। তাঁর কলমেই ঐন্দ্রিলার শরীরের হাল হকিকত জানতে পারেন অনুরাগীরা। সহজ সরল ভাষায় তিনিই লেখেন ঐন্দ্রিলার লড়াইয়ের গল্প।


সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে ফের লিখলেন ঐন্দ্রিলার ক্যান্সার-যাত্রার নয়া খণ্ড। 'আপডেট অন ঐন্দ্রিলা শর্মা' শীর্ষে অভিনেতা লিখছেন, 'প্রথমেই বলি, ঐন্দ্রিলা আগের থেকে একটু ভালো আছে। আমি ওর বিষয়ে কোনও সাক্ষাৎকার দিই না, তবে প্রতি মাসের শেষে আমি ওর বিষয়ে লিখি। এই প্রথমবার আমি সাহস করে ‘ভালো আছে’ লিখলাম। মা দুগ্গার আগমনিতেই হোক বা দীর্ঘ চিকিৎসার ফলেই হোক, এই মাসের শুরু থেকেই দেখলাম তার চিত্ত বেশ প্রফুল্ল। অনলাইনে সবার জন্য পুজোর জামা  কিনেছে, একদিন সেজেগুজে আমার সাথে ঠাকুর দেখতে গেছে, রেস্টুরেন্টে বসে বিরিয়ানি খেয়েছে, এমনকি বাড়িতে বায়না করে সকলকে দুইদিনের জন্য ঘুরতে যেতে রাজিও করিয়েছে। কথা ছিল অষ্টমীর ভোরে বাড়ির সকলে যাবে সমুদ্রদর্শনে, কিন্তু হলো না। সমুদ্রের পাড়ে জলের মধ্যে বসে কখনও মুঠো করে বালি ধরে দেখো, মুঠো যতই শক্ত করো না কেন, ঢেউ ফিরে যাওয়ার সময়ে কিছুটা বালি টেনে নিয়ে যায়। আমি দেখেছি, জীবনটাও অনেকটা ঠিক সেই রকমই। 


সপ্তমীর সকালে জানলাম ঐন্দ্রিলার মাসি গুরুতর ভাবে অসুস্থ, শ্বাসকষ্ট নিয়ে বহরমপুরে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। মাসিকে ও ‘দুষ্টুমা’ বলে ডাকে, আমার সাথেও আগে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে আগে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ক্যান্সারের সাথেই লড়াই চলছে ভদ্রমহিলার। একে একে বাদ গেছে শরীরের বেশ কিছু অংশ, তাও বেশ হাসিখুশি, প্রাণবন্ত একটি মানুষ। অষ্টমীর সকালে আমি ঐন্দ্রিলাদের সাথে করে নিয়ে গেলাম বহরমপুরে, তবে হাসপাতালে গিয়ে ওনার শারীরিক অবস্থা দেখে আমার একদমই ভালো লাগেনি, ছয় মাস আগে দেখা চেহারাটা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এদিকে, এতদিন পর নিজের শহরে ফিরে ঐন্দ্রিলা বেশ উৎসাহিত ছিল, ওকে তেমন বুঝতে দেওয়া হয়নি ওর মাসির শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা, তবে ও বাড়ি থেকে নিজে বেশি বেরোয়নি। ওর বাবা মা দুজনেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সাথে যুক্ত, ওনারাই হাসপাতালে যাওয়া আসা করছেন। আমি নিজে এই বিষয়ে একেবারেই মূর্খ, দুইদিন ধরে বহরমপুরে স্কুটি করে ঘুরে বেড়িয়েছি, কেবল একদিন বিকেলে ঐন্দ্রিলা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো মুর্শিদাবাদ হাজারদুয়ারীতে। সে সব গল্প অবশ্য আমি তোমাদেরকে শুনিয়েওছি। 


আরও পড়ুন: Jeet Ganguly New Song: মুক্তি পেল জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম ভক্তিগীতি 'তারা তুই'


দেবীপক্ষের শেষে, দশমীর রাতে আতশবাজির শব্দে দুগ্গামা চলে গেলেন আর একাদশীর ভোরে প্রায় নিঃশব্দে দুষ্টুমা চলে গেলেন।  
বহরমপুরের দুটি শ্মশানেরই বৈদ্যুতিক চুল্লি সেদিন অচল, তাই ওনাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লালবাগের কাছে একটি শ্মশানে। কোনও কটু গন্ধ নেই, নোংরা আবর্জনা নেই, আমি এরকম শ্মশান আগে দেখিনি। শ্মশানের ঠিক মাঝখানটিতে এক বিশাল বটবৃক্ষ তার সম্পত্তি আগলে দাঁড়িয়ে, তার সামনে হালে বানানো একটি অপেক্ষাগৃহ। শ্মশানের বাঁ দিকে একটি আশ্রম এবং ডানদিকে বয়ে চলেছে গঙ্গা। ছোট্ট বাঁধানো ঘাট, ঘাটের ধার ধরে কাশফুলের গুচ্ছ হাওয়ায় দুলছে, দুপুরের নীরবতা ভেঙে একটা পাখি থেকে থেকে ডেকে উঠছে। এ যেন ঠিক চিত্রপটে আঁকা, যেন সিনেমার সেট। আর ঠিক তার মাঝে সাদা চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে দুষ্টুমা। সামান্য ফুল ছড়ানো, ধূপের গন্ধ গায়ে। ঐন্দ্রিলা হেঁটে চলেছে তাকে শেষ দেখা দেখতে, শরীর প্রায় ছেড়ে দিয়েছে, হাতেপায়ে জোর নেই। বাঁ দিকে ধরে আছে ওর দিদিভাই আর ডানদিকে ওর বাবা। আমি এমনিতেও হাঁটি ঠিক ওর পেছনে, নিজের দুই হাত প্রসারিত করে ওর দুই কাঁধ সামান্য ছুঁয়ে থাকি, যদি পড়েও যায় তবে মাটির আগে আমার কোল স্পর্শ করবে। অনেকেই বারণ করেছিল ওকে সাথে নিয়ে যেতে তবে ওর বাবা বলেছিলো ‘যেতে চাইছে, যাক না’। আমিও অবশ্য পূর্ণ সমর্থন করেছিলাম তাকে, শেষ দেখাটুকু যে ওরও অধিকার, সেটা কেড়ে নেওয়া উচিত নয়।


বহরমপুর ছোট জায়গা, সবাই সবাইকে মোটামুটি চেনে। তাই অজস্র মানুষ শ্মশানে এসেছেন, আমি অবশ্য কাউকেই চিনি না কিন্তু মানুষ দেখা আমার নেশা আর আমার ইন্দ্রিয়গুলো বড় বেয়াক্কেলে, যা দেখার নয় তাই দেখে, যা শোনার নয় তাই শোনে, সামান্য গন্ধও আমার নাকে তীব্র হয়ে ধাক্কা মারে। গন্ধ পেয়েই ঘুরে দেখলাম কয়েকজন টলায়মান শ্মশানের ডোম হাসিমুখে দাঁড়িয়ে একটু দূরে, সম্ভবত আমায় চিনতে পেরেছেন তারা। সরে এসে বসলাম শ্বেতপাথরের সিঁড়ির এক কোনায়। বেশ কিছু মানুষ তখন সেখানে বসে , সিঁড়ির ধাপের অপর প্রান্তে ঐন্দ্রিলা আর ওর দিদিভাইকেও বসানো হয়েছে, দুজনেরই গাল ভর্তি জল। একটু আগেই দুস্টুমার পা জড়িয়ে কেঁদে এসেছে। হঠাৎ শুনলাম ঐন্দ্রিলার কয়েক ধাপ ওপরে বসে একজন বললেন, ‘কি করে হলো?’ অন্যজন বোঝাচ্ছেন, ‘ক্যান্সার হয়েছিল তো, মরে তো যাবেই। পাঁচ বছর বেঁচে ছিল সেই অনেক’।  ঐন্দ্রিলা মুখ ঘুরিয়ে লোকটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, যন্ত্রনায় কুঁকড়ে গেছে মুখটা। বাধ্য হয়ে উঠে গিয়ে বললাম, ‘গাড়িতে বসবে চলো’। 
ওদের গাড়িতে বসিয়ে আমি আরো কিছুক্ষণ ছিলাম সেখানে। স্বাভাবিকভাবেই ওর মেসো এবং খুব কাছের কয়েকজন সত্যিই শোকতপ্ত, পাঁচ বছরের লড়াইয়ের সাক্ষী যে তারা। এতদিনের লড়াইয়ের পর সামান্য নিমোনিয়াতে যে ফুসফুস অকেজো করে দেবে সেটা তখনও মানতে পারছেন না। বাকিদের চোখে অবশ্য আমি শোকের ছায়া দেখতে পাচ্ছি না। পুজোর গল্প আমার কানে আসছে, অফিসের গল্প কানে আসছে, ক্যান্সারে আর কে কে মারা গেছেন সেটাও শুনতে পাচ্ছি, আমি কয়েকজনের হাতে সবুজ রঙের কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতল দেখতে পাচ্ছি, সিগারেট আর চা তো আছেই। এদিকে আমার বাবার বয়সী বেশ কয়েকজন মানুষ এসে আমার সাথে ছবি তুলতে চাইছেন। ঐন্দ্রিলার বাবা হয়তো আমার অস্বস্তির কারণ বুঝেছিলেন, বললেন “চল, বেরিয়ে যাই”। আমি জানি, আসলে ওনাদের দোষ নয়, মানুষের জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী, এই আছে, এই নেই। তারই মধ্যে মানুষ যেটুকু পায়, সেটুকুই চেটেপুটে নেওয়ার চেষ্টা করে।  


আরও পড়ুন: Happy Birthday Shah Rukh Khan: 'বাদশা'-র জন্মদিনে শুভেচ্ছাবার্তা আয়ুষ্মান খুরানা, সিমি গারেওয়ালের


তবে উপলব্ধি করলাম, অনেকের কাছ থেকে দুষ্টুমা হয়তো বহুদিন আগেই চলে গিয়েছিলেন, সেদিন ছিল কেবল দাহ করার পালা।  
সত্যি বলতে, আমি যতই আবেগপ্রবণ হই না কেন, সেখানে উপস্থিত বাকিদের মতনই দুষ্টুমার কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আমারও ছিল না। ছিল শুধু ঐন্দ্রিলার। পুজোর কিছুদিন আগে দুজনে দুজনকে জামা উপহার দিয়েছে। কেমোর পর, একে অপরকে ফোন করে কষ্ট ভাগ করে নিতো। একই যুদ্ধে সামিল সহযোদ্ধার পতন দেখা সহজ নয়। আমি জানি, ঐন্দ্রিলা সেদিন ভেঙে পড়েনি, ধসে পড়েছিল। আমি ওর চোখে কেবল শোক দেখিনি, ভয়ও দেখেছিলাম।
তখন প্রায় বিকেল, সূর্য লাল হতে শুরু করেছে, নদীর রং পাল্টে গেছে। গাড়িতে উঠে যখন শ্মশান ছেড়ে বেরোচ্ছি, দূর থেকে শুনলাম ইলেক্ট্রিক চুল্লির বেল বেজে উঠলো। দুষ্টুমার শেষযাত্রা শুরু হবে। স্কুলে থাকতে শেক্সপীয়ারের উদ্ধৃতাংশ পড়েছিলাম, “all the world’s a stage..” 
সত্যিই তাই।
পর্দা ওঠানোর আগে মঞ্চে বেল বাজানো হয় আর যবনিকা পতনের আগে শ্মশানে।' (অপরিবর্তিত)



ক্যানসারের সঙ্গে প্রতিনয়ত লড়াই, কেমোর যন্ত্রণা, তা সত্ত্বেও ঐন্দ্রিলার প্রাণশক্তি অফুরন্ত। দিন দুই আগে প্রিয় মানুষের জন্মদিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিষ্টি পোস্ট করেন ঐন্দ্রিলা। বিনোদন জগত থেকে শুরু করে তাঁদের অনুরাগী সকলেই চান, একেবারে সুস্থ হয়ে শ্যুটিং ফ্লোরে ফিরুক হাসিখুশি ঐন্দ্রিলা। রোগমুক্তি ঘটুক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।