কলকাতা: 'এ আমার গুরুদক্ষিণা'। পাড়ার দুর্গাপুজো মানেই এই গানটা বাজবে। সঙ্গীতশিল্পী শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাছে তাই এখনও পুজো মানেই বাপ্পি লাহিড়ির গান মাস্ট। এবিপি লাইভের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ছেলেবেলার পুজোর প্রসঙ্গ উঠতেই শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরল স্বীকারোক্তি, 'প্রশ্ন করায় এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে সত্যিই ছোটবেলার পুজো বলেও একটা জগৎ ছিল। ছোটবেলায় পুজোর যে একটা আলাদা করে ছুটি পড়ত স্কুলে সেই ছুটির অনুভূতিটাই হারিয়ে গেছে যবে থেকে পেশাগতভাবে গানবাজনা শুরু করেছি।'


বাড়ি কলকাতায় হলেও শিবাশিসের জন্ম হলদিয়ায়। বাবার চাকরিসূত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত হলদিয়াতেই কেটেছে তাঁর। হলদিয়ার পুজোর বিশেষ স্মৃতি না থাকলেও তাঁর কথায় স্পষ্ট ওখানে প্রত্যেকটা পরিবারের মধ্যে বেশ অন্তরঙ্গতা ছিল। 'হলদিয়ায় আমরা যেখানে থাকতাম সেখানকার বাকি পরিবারগুলিও বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে চাকরিসূত্রে ওই অঞ্চলে বাস করতেন। ফলে সকলের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গতা, একাত্মবোধ ছিল। কলকাতায় যেমন সকলে নিজস্ব জগতে খুব প্রতিষ্ঠিত ওখানে সেটা ছিল না। তাই থাকতে হলে একসঙ্গেই থাকতে হবে এই বোধটা সকলের মধ্যে খুব কাজ করত,' বলছেন শিবাশিস।


এরপর হলদিয়া ছেড়ে কলকাতায় পুরোপুরি থাকা শুরু হয়। পুজোর এই চার-পাঁচটা দিনে প্রত্যেক আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসতেন, যাঁদের সঙ্গে এখন আর নিয়মিত দেখাও হয় না শিবাশিসের। তিনি জানাচ্ছেন, প্রত্যেক বছর একসঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করা হত। গাড়ি ভাড়া করে সারারাত ধরে ঠাকুর দেখা হত প্রতিবার। তাঁর কথায়, 'আরও একটা বিষয় আমারা খুব বিস্ময়কর লাগত। আমার বিধবা ঠাকুমাকে আমি বছরের আর পাঁচটা দিন যেভাবে দেখে অভ্যস্ত থাকতাম, পুজোর পাঁচদিন তার থেকে একেবারে আলাদা দেখতাম। তিনি যে শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধা নন, দিনের শেষে একজন মহিলা, সেটা তাঁর নিয়মকানুন মানা দেখে বোঝা যেত।'


শিবাশিসের কথায়, 'পেশাগত কারণে এখন কীভাবে আবহ সঙ্গীত তৈরি হয় তার সবটাই প্রায় জেনে গেছি। কিন্তু ছেলেবেলায় এই সম্পর্কে তো কোনও আইডিয়া ছিল না। তাই পুজো স্পেশাল আবহ সঙ্গীত শোনার একটা আলাদা মজা পেতাম, অন্য়রকম উপলব্ধি ছিল।'


পুজোয় বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি এখনও তাঁর মনে উজ্জ্বল। মজার মুহূর্ত মনে করতে গিয়ে তিনি বলেন 'তখন তো কারও হাতেই তেমন টাকাপয়সা থাকত না। বাড়ি থেকে যেটুকু টাকা দিত সেটাই সম্বল। কিন্তু বড়দের থেকে শুনেছিলাম ওঁরা পার্কস্ট্রিটে খেতে যান। জায়গার নামগুলো জানা ছিল। কিন্তু পুজোয় যে পার্কস্ট্রিটে ভিড় হয় বা কোথায় খেতে কত টাকা লাগে কিছুই জানতাম না। আমার মনে আছে আমরা সাত-আটজন বন্ধু মিলে ৩০০টাকা নিয়ে পার্কস্ট্রিটের 'ট্রিঙ্কাজ়'-এ গিয়েছিলাম। মেনুকার্ড দেখে চোখ কপালে উঠেছিল। খুব লজ্জাজনক ঘটনা ছিল। এখন ভাবলে হাসি পায় কিন্তু তখন যে কীভাবে ম্যানেজ করেছিলাম সেটা আমরাই জানি। এরপর যদিও ফের গেছি সেখানে, প্রথম প্রেমিকাকে নিয়েও গেছি।'


তাহলে পুজোয় প্রেম এসেছে নিশ্চয়ই? প্রশ্ন শুনে হাসতে থাকেন সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর উত্তর, 'ওই একবারই স্কুলে পড়ার সময় পুজোয় প্রেম এসেছিল। তাও প্রেমিকার বাড়িতে জানানো যেত না। ফলে বন্ধুদের অজুহাতে বেরিয়ে বাকিদের থেকে দলছুট হয়ে আলাদা সময় কাটিয়েছিলাম। বলতে গেলে ওই নাগরদোলা চড়ে বাড়ি চলে এসেছিলাম। এরপর কাজকর্মের চাপে আর 'পুজোয় প্রেম' হয়ে ওঠেনি।'


এই গল্প করতে করতেই শিবাশিসের উপলব্ধি, 'আসলে ছেলেবেলার মজাটা ছিল যা করেছি সেটাই স্বেচ্ছায় করেছি। পুজোয় নিজের ইচ্ছায় ঘুরতে যেতাম। কিন্তু এখন কাজের অনুমতির অপেক্ষা করতে হয়। কাজ থেকে যবে ছুটি মিলবে সেদিনই তোমার 'হলি-ডে'। ছোটবেলায় সেই যে নিজেরা ট্রিঙ্কাজ়ে গেলাম, ৩০০ টাকায় হয়তো একটাই কোনও আইটেম ভাগ করে খেতে পেরেছিলাম, কিন্ত একা সমস্তটা করার মধ্যে একটা রোমাঞ্চ ছিল। বাড়িতে গিয়ে যে সকলকে বলতে পারব এই গল্পটা এতে একটা নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ারও অনুভূতি ছিল।'


ছোটবেলায় তাঁর পাড়ার পুজোর সময়ে বাপ্পি লাহিড়ি, আর. ডি. বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বেশি বাজানো হত। 'এছাড়া এক বছর পুজোয় রূপঙ্কর দা-র 'ভো কাট্টা' গানটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পাড়ায় তখন এই গানগুলো খুব বাজত,' বলছেন শিবাশিস। 


লাইভ শো করার সময় গোটা পুজো অনুষ্ঠান করেই কেটে যেত। তবে ২০১৭ সাল থেকে পুরোপুরি বিজ্ঞাপনী সঙ্গীত ও ছবির সঙ্গীত পরিচালনায় মন দিয়েছেন শিবাশিস। তখন থেকে পুজোয় বাড়িতে কাজ করে বেশিরভাগটা কেটে যায় তাঁর, কারণ পুজোর সময় নানান ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের কাজ থাকেই। এছাড়াও তিনি খুব একটা পুজোয় ঘুরতে বেরোতে পছন্দ করেন না, কারণ তাঁর কথায়, 'কার সঙ্গে বেরোব সেই নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন ওঠে। ছোটবেলায় যাঁদের সঙ্গে বেরোতাম তাঁরা কেউই প্রায় এখানে থাকেন না। আর কাজের সূত্রে যাঁদের সঙ্গে আলাপ তাঁদের সকলের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সময় কাটানোর মতো বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে এমনও নয়।' এবারেও করোনার জন্য পুজোর একটি অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। তাই এই বছরের পুজোতেও আপাতত বিশেষ প্ল্যান নেই শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। 


আরও পড়ুন: Durga Puja 2021 Exclusive: অষ্টমী বা নবমীর সকালে বাবা ট্যাক্সি করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন: লোপামুদ্রা