জামসেদপুরের মেয়ে। তবে এখন হলিউডও মুগ্ধ প্রিয়ঙ্কা চোপড়া-য়। আভা গোস্বামী-র বিশ্লেষণ
তিনি লাস্যময়ী।
তাঁর অবাধ্য চুল, গমরঙা শরীর।
বাঁক-ঝোঁক শরীরে উদ্ধত যৌবন। মস্তিষ্কে ধারালো বুদ্ধি। আজ আমেরিকাকেও মুগ্ধ করেছে।
এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর উচ্চতা কত? বলেছিলেন, ‘‘ফাইভ-সিক্স অ্যান্ড থ্রি কোয়ার্টার্স।’’ বলেছিলাম, কোয়ার্টার্স না লিখে যদি ফাইভ সিক্স অ্যান্ড আ হাফ লিখি? তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘‘নো নো আই ওয়ান্ট মাই কোয়ার্টার’’—নিজের এই ‘কোয়ার্টার’ জমিটুকুও না ছাড়ার জেদ থেকেই প্রিয়ঙ্কা চোপড়া বিদেশে কাজ করা অন্যান্য অভিনেতার চেয়ে আলাদা হয়ে যান।
ইরফান খান, অনিল কপূর বা ফ্রিডা পিন্টো সকলেই আন্তর্জাতিক অভিনেতা হিসেবে আজ পরিচিত। কিন্তু প্রিয়ঙ্কার কৃতিত্ব এঁদের চেয়ে অনেক বেশি। ভারতের এক প্রথম সারির অভিনেত্রী থেকে আমেরিকান নেটওয়ার্ক শো-র তিনি একজন অতি পরিচিত মুখ। আমেরিকাও ফিরে দেখছে তাঁর অতীতকে। তিনিই তো মিস ওয়ার্ল্ড! তিনিই সে, যে ‘গেস’য়ের মতো ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের জনপ্রিয় মুখ! তিনি সেই মিউজিশিয়ান যিনি পিট বুল আর ‘হুইল’য়ের সঙ্গে কাজ করে দুনিয়া কাঁপাচ্ছেন!
এই প্রিয়ঙ্কা চোপড়াকে কুর্নিশ জানাচ্ছে এখন গোটা পৃথিবী। জনপ্রিয় টেলিভিশন শো ‘কোয়ান্টিকো’য় অভিনয় করেছেন তিনি। অস্কারে আমন্ত্রণ পেয়েছেন নিজের আকর্ষণীয় ফ্যাশন স্টেটমেন্টের জোরে। নিয়মিত ওঠাবসা ডোয়েন জনসনের সঙ্গে। পোস্ট করছেন ছবি। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভোজ সভায় অংশ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ‘দেশি গার্ল’। টুইট করেছেন, ‘‘খুব ভাল লাগল বারাক ওবামা এবং মিশেল ওবামার সঙ্গে দেখা করে। পেলাম এক সুন্দর সন্ধ্যা। ধন্যবাদ।’’
জীবনটাকে আর পাঁচটা মেয়ের মতো করে কোনও দিন ভাবেননি প্রিয়ঙ্কা। না হলে জামসেদপুর থেকে মুম্বই পাড়িই দিতেন না। রাস্তাটা তখনও সহজ ছিল না। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বার বার তোলপাড় হয়েছে মিডিয়ায়। শুনেছি, কখনও অক্ষয়কুমার, কখনও শাহরুখ খানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা। তাতেও জেদি প্রিয়ঙ্কা ছেড়ে কথা বলেননি। সরাসরি কাউন্টার করেছেন। বলেছেন, ‘‘নায়িকা হলেই কাজের চেয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। এটা কবে বন্ধ হবে?’’ একটা সময় এমন এসেছিল যখন তাঁর কাজ নিয়ে কেউ কোনও কথাই বলত না। কানাঘুষো শুনতাম ইন্ডাস্ট্রি তাঁকে নাম দিয়েছে ‘ইন্ডাস্ট্রির অ্যান্টি ওয়াইফ হিরোইন’। পার্টিতে গেলে টের পেতাম, অনেক নায়কের বৌ বেজায় খাপ্পা তাঁকে নিয়ে। কেমন যেন একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন প্রিয়ঙ্কা।
তাতেও দমানো যায়নি ‘ফ্যাশন’য়ের হিরোইনকে। ভারতে বেশির ভাগ অভিনেত্রীরা যখন ছবি হিট করার পর নিজের সাফল্য নিয়ে মজে থাকছেন, তখন প্রিয়ঙ্কা মুম্বইতে শ্যুট শেষ করেই ষোলো-সতেরো ঘণ্টা ট্রাভেল করে যেতেন লস এঞ্জেলিস। তৈরি করছিলেন নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তিন বছরে এই ছোটাছুটি কাজেও এসেছিল। ফল ‘কোয়ান্টিকো’র সুযোগ। ‘বেওয়াচ’য়ে লিড রোল।
অনেকেই হয়তো জানেন না, প্রিয়ঙ্কার হলিউডে পা রাখার পিছনে শাহরুখ খানের অবদানের কথা। এসআরকে-ই প্রথম প্রিয়ঙ্কাকে বলেন যে, বলিউডের বাইরেও ওঁর গানের দিকে আলাদা করে নজর দেওয়া উচিত। সে কথা শুনেছিলেন প্রিয়ঙ্কাও। ‘রা ওয়ান’য়ে কাজ করার সময় থেকে একন-এর সঙ্গে শাহরুখের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। তিনিই একনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন প্রিয়ঙ্কার। সুযোগ, প্রতিভা আর পরিশ্রম... সময় লাগেনি হলিউডের বড় রেকর্ড লেবেলের সঙ্গে নিজের নাম জড়ানোর। প্রকাশ পায় নিজের অ্যালবাম ‘মাই সিটি’।
শাহরুখ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘প্রিয়ঙ্কা আমাদের প্রথম ক্রিয়েটিভ এক্সপোর্ট।’’ সত্যিই প্রকৃত অর্থে একজন ‘ক্রসওভার স্টার’ হয়ে উঠছেন প্রিয়ঙ্কা। শাহরুখের সাহায্য অস্বীকার করেননি তিনিও। তবে অনেকে প্রিয়ঙ্কার কেরিয়ারের জন্য শাহরুখের এই ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে দু’জনের রোম্যান্টিক সম্পর্কের গন্ধ পেয়েছিলেন। সেটা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়ায়ও যায় না। প্রিয়ঙ্কার কেরিয়ারের শুরুটাও কিন্তু বেশ এসআরকে ঘরানার। বাদশা খান যেমন বলিউডে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ‘ডর’ বা ‘বাজিগর’য়ে অ্যান্টি-হিরোর চরিত্রে, প্রিয়ঙ্কার শুরুও তেমন সুভাষ ঘাইয়ের ‘এতরাজ’য়ের অ্যান্টি-হিরোইনের চরিত্রে। তার পরের গল্প তো সবার জানা। হলিউডেও কিন্তু প্রিয়ঙ্কা নিজের রোড ম্যাপটা সাজিয়ে ছিলেন বলিউডের ধাঁচেই। ‘কোয়ান্টিকো’ থেকে ‘বেওয়াচ’ — প্রিয়ঙ্কার চরিত্র কিন্তু কিছুটা নেগেটিভই।
কথায় আছে, কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়। প্রিয়ঙ্কাকেও তেমনই হলিউডের ফ্লাইট ধরতে গিয়ে বলিউডের জমি কিছুটা হারাতে হয়েছে। তার মানে কি প্রিয়ঙ্কা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন বলিউডকে একটু কম গুরুত্ব দেবেন? প্রিয়ঙ্কার ঘনিষ্ঠ লোকের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, প্রিয়ঙ্কা সেটাই করছেন। ওঁর প্রায়োরিটি লিস্টে এখন হলিউড।
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে এ নিয়ে কানাঘুষো শুরু হয়েছিল আগেই, যখন ‘বাজিরাও মস্তানি’র প্রচারে দেখা যাচ্ছিল না প্রিয়ঙ্কার মুখ। কিন্তু প্রিয়ঙ্কার পেশাদারিত্বের অভাব আছে — এ কথা তাঁর সব থেকে বড় শত্রুও বলতে পারবে না। ছবির
প্রচারে যে তাঁকে দেখা যায়নি, এ কথা লোকে ভুলে গিয়েছিল দুই ছবিতেই
ওঁর অসাধারণ অভিনয় দেখে। ‘বাজিরাও মস্তানি’তে দীপিকার মস্তানির চেয়েও প্রিয়ঙ্কার কাশীবাইয়ের ব্যথা দর্শকের মনে বেশি বেজেছিল।
অনেক দিনই বলিউডে নতুন কোনও ছবির কাজে হাতও দেননি। তাঁর সময় দিতে না পারার জন্যই আটকে আছে মধুর ভান্ডরকরের ‘ম্যাডামজী’। তবে ছবির শ্যুটিং পিছিয়ে দিতে হলেও প্রিয়ঙ্কার সাফল্যে খুশি মধুর। মঙ্গলবার সকালে ফোনে বললেন, ‘‘প্রিয়ঙ্কার আগে বিশ্বমানচিত্রে কোনও ভারতীয় অভিনেতা এতটা দাপট নিয়ে অভিনয় করেনি। কে ভেবেছিল কোনও ভারতীয়র নাম ‘কোয়ান্টিকো’ বা ‘বেওয়াচ’য়ে প্রধান চরিত্র হিসেবে থাকবে! প্রিয়ঙ্কা সেটা করে দেখিয়েছে। ওর হলিউডে সময় দেওয়ার জন্য যদি আমার ছবি পিছিয়ে দিতে হয়, তাতেও আমার কোনও মনখারাপ থাকবে না।’’
আসলে হলিউড-বলিউড — দুই ইন্ডাস্ট্রির নৌকোতে পা রেখে চলা মোটেই সহজ নয়।
জামসেদপুরের মেয়ে খুব ভাল ভাবেই সেটা জানতেন। তাই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর প্রথম পছন্দটা।
হবে না-ই বা কেন!
ক’জন অভিনেতাই বা ডলারে রোজগার করতে পারেন।