কলকাতা: পরস্পরের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম। তার ফলেই মহম্মদ রফি (Mohammed Rafi) থেকে কিশোর কুমার (Kishore Kumar) বা মান্না দে (Manna Dey), সবার সঙ্গে জুটিতে সাবলীল ছিলেন লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। দুর্দান্ত বোঝাপড়ার জন্য সৃষ্টি হয় একের পর এক কালজয়ী গান।


‘শ্রী চারশো বিশ’ (Shree 420) ছবিটি এই প্রজন্মের অনেকেই হয়ত দেখেননি। কিন্তু, এই কালজয়ী ছবির কালজয়ী গান, 'পেয়ার হুয়া, ইকরার হুয়া' শোনেননি, এমন কাউকে খুঁজে বার করা দুষ্কর। ছবিতে এই আইকনিক গানে রাজ কপূর এবং নার্গিসকে দেখা গেলেও গানের কণ্ঠ কাদের ছিল জানেন নিশ্চয়? লতা মঙ্গেশকর এবং মান্না দে। 


‘অভিমান’ ছবির 'তেরি বিন্দিয়া রে...' গানটা মনে আছে? লতা মঙ্গেশকর-মহম্মদ রফির সেই ডুয়েট! আর লতা-কিশোর জুটি তো উপহার দিয়েছে অজস্র কালজয়ী গান। রেকর্ডিং স্টুডিওর বাইরেও লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে এই শিল্পীদের সম্পর্ক ছিল একেবারে পরিবারের মতোই!


কিশোর কুমারকে লতা ডাকতেন কিশোরদা বলে। কিশোর কুমারকে রাখিও পরাতেন প্রতি বছর। কিন্তু, কিশোর কুমারের সঙ্গে রেকর্ডিং পড়লে, লতার টেনশন শুরু হয়ে যেত। কেন জানেন? ঘনিষ্ঠদের কাছে লতা গল্প করেছিলেন, 'কিশোরদা কিছুতেই রিহার্সাল করতেন না। রেকর্ডিংয়ের দিনও এর সঙ্গে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে চলে যেতেন। কিন্তু, গানের বেলায় এসে অবলীলায় নিজের লাইনগুলো, এতটুকু সুর থেকে না সরে গেয়ে দিতেন। তারপর আবার মজার মজার কথা বলতে শুরু করে দিতেন। যা শুনে লতারও হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে যেত। তারপর গান গাইতে ঘাম ছুটে যেত।' সেই কারণে কিশোরদার সঙ্গে রেকর্ডিং থাকলে, লতা চিন্তায় পড়ে যেতেন।


আবার মহম্মদ রফি সম্পর্কেও তাঁর মনে ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। তিনি সব জায়গায় বলতেন, 'একশো বছরেও মহম্মদ রফির মতো কণ্ঠ আর আসবে না।' তবে এই রফির সঙ্গে লতার একবার মতান্তরও হয়েছিল। লতা চেয়েছিলেন, গানের জন্য শিল্পীকে ৫০ শতাংশ রয়্যালটি দেওয়া হোক। কিন্তু রফির বক্তব্য ছিল, গান করে এক বার পয়সা নিয়েছি, আবার কী! অনেকে লতা মঙ্গেশকরকে ডিপ্লোম্যাটিক বলে সমালোচনা করেছিলেন। যদিও, অনেক পরে লতা এনিয়ে বলেছিলেন, 'আমি যদি ডিপ্লোম্যাটিক হতাম তা হলে কি আমি রয়্যালটি নিয়ে এত সরব হতাম? সেই সময় যেটা আমার দাবি ছিল, তার জন্য লাভবান হয়েছেন আর্টিস্টরাই। তা হলে কেন আমাকে ডিপ্লোম্যাটিক বলা হবে?'


তবে এই টানাপোড়েনের জেরে দুই শিল্পীর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এতটুকু কমেনি। শেষ দিন পর্যন্ত লতার মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে বাজত মহম্মদ রফির কণ্ঠে ভজন। 


আরও পড়ুন: Lata Mangeshkar Demise: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সলিল চৌধুরী, বাংলার সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের গভীর বন্ধন


মান্না দে ছিলেন লতার আরও এক প্রিয় সহশিল্পী। প্রায়শই বলতেন, 'এত ডুয়েট গাইলাম এত জনের সঙ্গে। কিন্তু ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’-র মতো গান কোথায়?' আজও বলিউডের সফল সুরকার, গায়কদের কাছে লতা মঙ্গেশকর মানেই অনুপ্রেরণা।


সঙ্গীত শিল্পী উদিত নারায়ণের কথায়, 'উনি "নাইটিঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া"। কখনও ভাবিনি, আমি মুম্বই এসে তাঁর দর্শন পাব, কাজ করার সৌভাগ্য হবে। আমি স্টুডিওতে যেতাম, ওঁকে গাইতে দেখতাম। তারপর একদিন পঞ্চম দা ডাকলেন, উনি ৪ লাইন গাইতে বললেন। আমাকে দেখে লতাজি বললেন, তুমি ৪টে লাইন গাও, লাইফ হয়ে যাবে।'


কুমার শানু বলেন, 'বাপিদার গানে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেয়েছিলাম। আমি তো ভাবতেই পারিনি, কে আছে। কেউ বলছেন না। পাশে একটা শর্ট মাইক্রোফোন রাখা, তখন এলেন লতাজি, পা পর্যন্ত তাঁর চুল তখন। আমি প্রণাম করলাম ওঁকে। আমাকে বললেন, তুমি তো ভাল গাও, আমি তখন কাঁপছিলাম, প্রথম রেকর্ডিং ওঁর সঙ্গে।'


বছরের পর বছর পেরিয়েছে। লতা-রফি, লতা-কিশোর, লতা-মান্নার বিকল্প আজও নেই। এই শিল্পীদের কেউই আজ আর নেই। কিন্তু, তাঁদের গানের চির সবুজ। আনন্দে-বিষাদে আজও 'ওল্ড ইজ গোল্ড'।


আরও পড়ুন: Lata Mangeshkar Death : সমদীপ্তা থেকে অরুণিতা, লতার আশীর্বাদ এভাবে পাবেন ভাবেননি দুই বঙ্গতনয়া !