উমেশ তামাং, কলকাতা: নেটফ্লিক্স (Netflix) অরিজিনাল ফিল্ম ‘কোবাল্ট ব্লু’ (Cobalt Blue)। ছবির শুরুতেই দেখা যায়, কলেজ পড়ুয়া তনয় প্রফেসরের প্রশ্নের উত্তরে বলে যে সে পরিযায়ীদের যন্ত্রণা বোঝে। তাকেও ছোটবেলায় ছিন্নমূল হতে হয়েছে। মহারাষ্ট্র থেকে কেরলে চলে আসতে হয়েছে। কারণ কর্মসূত্রে বাবাকে চলে আসতে হয় কোচি। তনয়ের দাদু-ঠাকুমা একইদিনে মারা যান। তার পর বাড়ির দোতলার ঘরটি পাওয়ার আবদার রেখেছিল তনয়। কিন্তু সেই ঘরে পেয়িং গেস্ট ঢোকান গৃহকর্তা। সেই পেয়িং গেস্ট-এর ভূমিকায় রয়েছেন প্রতীক বব্বর (ছবিতে চরিত্রের নাম উহ্য রেখেছেন পরিচালক)। চিত্রশিল্পীর চরিত্রে রয়েছেন তিনি আর তাঁর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই কাহিনীতে স্বপ্ন, বাস্তব, কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই এই আগন্তুকের জন্য তনয়ের মনের মধ্যে ভাললাগা জন্ম নেয়। কিন্তু আগন্তুক যেন আলো-আঁধারি জগতের এক মানুষ। নিজের পরিচয়, ধাম, উদ্দেশ্য কোনও কিছুই খোলসা করে না সে। এমনকি নিজের তোলা এবং আঁকা ছবির চরিত্রদের নিয়েও রহস্য জিইয়ে রাখে।
এ দিকে তনয়ের মধ্যেও কবিসত্ত্বা রয়েছে। সে সাহিত্য চর্চা করে। তার লক্ষ্য হল, জীবনে কোনও একটি উপন্যাস লিখবে। কিন্তু যত বারই লিখতে গিয়েছে, কবিতা হয়ে নেমে এসেছে লেখা। আগন্তুককে জানালে উত্তর মেলে, একদিন নিশ্চয়ই ,ফল হবে তনয়। কষ্ট করে তাকে লিখতে হবে না, উপন্যাসই তার কলম থেকে ঝরে পড়বে। এই গল্পে তনয়ের বোনও রয়েছে, অনুজা। হকি খেলোয়াড় অনুজা টমবয়, খেলা ছাড়া কিছু বোঝে না। বাড়ির চাপে শাড়ি পডরে, পরচুলা পরে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে বাধ্য হয়।কিন্তু সুযোগ আসে তার কাছে। হকি কোচের চাকরি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় কোহিমায়। প্রতি পদে পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে অনুজাকিন্তু আগন্তুকের সামনে নিজেকে সামলাতে পারে না সে-ও। এক রাতে আগন্তুকের সামনে পালিয়ে যায় সে।
এই ঘটনায় ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তনয়। কলেজের এক অধ্যাপকের সঙ্গে ভাগ করে নেয় যন্ত্রণা। ওই অধ্যাপক আবার সমকামী। নীল ভোপালন এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাঁর চরিত্রের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয় তনয়। আবার অভয় দেন এই বলে যে, মহিলাদের প্রেমিক ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। এতেই প্রশ্ন ওঠে, অধ্যাপক কি সমকামী এবং উভকামীর পার্থক্ বোঝেন না! নাকি সমস্ত সমকামীই আসলে উভকামী, সেটাই বোঝানোই উদ্দেশ্য। পাশাপাশি পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেম ভাঙার জন্য এক জন মহিলার উপরে যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দেওয়ার এই ধরন লিঙ্গরাজনীতির দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। এই গুরুতর বিষয়টির এমন সরলীকরণ উত্তর আধুনিক যুগে বড়ই বেমানান। কারণ যৌনতার সংজ্ঞা এবং পরিসর যখন ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, এই ছবি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনও ইতিবাচক বার্তা দিতে পারল না। বরং শুধু মহিলাদের দিকে আঙুল তুলে লিঙ্গরাজনীতির নোনা ধরা চেহারাটাই প্রকট হল।
এই ছবি যদিও কিছু স্টিরিওটাইপ ভাঙার চেষ্টা করেছে। সম্পর্ক ভাঙার দুঃখ, যন্ত্রণা শুধুই যে লিঙ্গভিত্তিক নয়, যৌন পরিচয়ের বাইরেও বহুস্তরীয় পরিচয় থাকে মানুষের, যার তার উদযাপন একাই করা যায়, ধর্ম কখনও বন্ধুতার রাস্তায় খাঁড়া হাতে দাড়ায় না, এমন অনেক শুভ চেষ্টা ছরা পড়েছে। কোনও মেয়ের চলন-বলন টমবয়-সুলভ হলে, মোটর সাইকেল চালালেই যে সে সমকামী, পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট নন, এই ধারণাও ভাঙার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। ‘কোবাল্ট ব্লু’ আসলে তনয়েরই স্বপ্ন পূরণের ফসল, সেটি তনয়ের লেখা প্রথম উপন্যাস।
শেষে বলতেই হয়, এই সিনেমার চিত্রনাট্য বাস্তবেই ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘কোবাল্ট ব্লু’ উপন্যাসটির অনুপ্রেরণায় লেখা হয়েছে। উপন্যাসটি প্রকাশের ২৬ বছর বাদে ২০২২-এ এসে এই ছবি মুক্তি পেল। ছবিটির শ্যুটিং শুরু হয়েছিল ২০১৯-এ। তাই কিছু অসঙ্গতি রয়ে গিয়েছে। যেমন একটি দৃশ্যে অধ্যাপক তনয়কে ‘ভারতে সমকামিতা আইনের চোখে অপরাধ’। ভারতে কিন্তু ২০১৮-য় সমকামিতাকে অপরাধমূলক আচরণের আওতা থেকে বার করে আনা হয়েছে। এই ভুল বার্তা কিন্তু আটকানো যেত।