কলকাতা: ঘরেই তৈরি হয়েছে শ্যুটিং সেট। সেখানেই দিনের শ্যুটিং শেষ করলেন। স্পটলাইট নিভিয়ে নিখিলের মেক-আপেই ফোন তুললেন অভিনেতা। কয়েকদিন আগেই করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। কিন্তু জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'কৃষ্ণকলি'-র ব্যাটন তাঁরই কাঁধে। মূল গল্প থেকে যাতে 'কৃষ্ণকলি' না সরে তাই আইসোলেশানে থেকেই 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' করছেন তিনি। পর্দায় দর্শক যাঁকে গোটা পরিবারের সঙ্গে দেখে অভ্যস্ত, বাস্তবে নিজের বাবা-মায়ের থেকেও দূরে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। কতটা কঠিন কোভিডের সঙ্গে লড়াই? একা হাতে কী করে সামলাচ্ছেন শ্যুটিংয়ের গুরুদায়িত্ব? মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দ-র সঙ্গে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন নীল ভট্টাচার্য্য।


লকডাউনের সময় ছেদ পড়েছিল শ্যুটিং-এ। তখন বাড়িতে বসে টিকটকে ভিডিও বানিয়ে সময় কাটিয়েছেন নীল। চিনা এই অ্যাপ বাতিল হবার পর বন্ধ হয়েছে সেই সুযোগও। কিন্তু বাড়িতেই রাখা ছিল স্পটলাইট, আইফোন, ট্রাইপড। কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ আসার পরে বোধহয় সেগুলোর দিকে তাকিয়েই শ্যুটিং চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নীল। মোবাইলের ওপার থেকে বললেন, 'আমি টিকটক করতে ভালোবাসতাম। এর আগে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়ে হামেশাই শ্যুটিং করতাম। তখন মা ক্যামেরা ধরে থাকত বা অন্যান্য সাহায্য করত। এখন নিজেই সবকিছু তৈরি করে নিতে হচ্ছে। নিজেই ক্যামেরা রোল করে ডায়লগ বলি, আবার কেটে ট্রান্সফার করি। একটু কঠিন তো বটেই। কিন্তু আমি যতটা পারছি সাহায্য করছি যাতে কৃষ্ণকলি মূল গল্প থেকে না সরে যায়। আমি শ্যুটিং না করলে হয়ত চিত্রনাট্য বদলে দেখাতে হত আমাকে অপহরণ করা হয়েছে বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'



একাই চলছে শ্যুটিং। তাই ছবি তুলতে হলে ভরসা সেলফিই

প্রতিদিন ১ - ২ ঘণ্টা শ্যুটিং করতে হচ্ছে নীলকে। তবে বাড়িতে সেট সাজানো শুরু করে নিজেকে নীল থেকে নিখিল করে তোলা, সবকিছু করতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে রোজ। তবে তাতে আপত্তি নেই নীলের। বরং বলছেন, 'আমার পরিচালক, একজিকিউটিভ প্রযোজক, এডি আমায় ভীষণ সাহায্য করছেন। পরিচালকই তো চিত্রনাট্য  লিখছেন। উনিই আমায় গোটা সিনটা বুঝিয়ে দেন। শ্যুটের সময় আমার ২টো ফোনের একটায় ভিডিও কলে পরিচালক, প্রযোজকরা থাকেন। কোনদিকে লুক দিতে হবে, কখন বসতে হবে, মুভ করতে হবে, এই সাধারণ ব্যাপারগুলো ওঁরা বলে দেন। কখন কী অভিব্যক্তি হবে সেই বিষয়ও বুঝিয়ে দেন। আমায় বাদ দিয়ে শ্যুটিংটা তো আগেই হয়ে যায়। সেটার সঙ্গে মেলানোর জন্য ওঁরা কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। সবার টিম এফর্টের জন্য কাজটা এগোচ্ছে।'





কথা বলতে বলতেই শ্যুটিং-এর একটা দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল নীলের। বললেন, ' একদিন খুব ক্লান্ত ছিলাম। সারাদিন ঘুমিয়েছি। রাত ১১টায় উঠে মনে হল এখন শরীর ঠিক লাগছে। ১১টা থেকে ১টা শ্যুটিং করলাম। তখনও ভিডিও কলে ছিলেন পরিচালক। এমনভাবেই স্ক্রিপ্ট লেখা হয় যাতে আমার শরীরের ওপর চাপ না পড়ে। আমায় সবসময় বলা হয়, যখন আমার সুবিধা হবে তখনই শ্যুটিং করতে।'



গত সোমবার কোভিড টেস্ট করেছিলেন, আর তারপরেই 'কৃষ্ণকলি'-র সেট থেকে শারিরীকভাবে দূরে রয়েছেন তিনি। কিন্তু নিয়ম করে খোঁজ নিচ্ছে গোটা টিম। শরীর কেমন আছে থেকে অসুধ খেয়েছে কিনা, ফোনের ওপার থেকে প্রকাশ পাচ্ছে শুধুই উদ্বেগ। নীল বলছেন, 'শ্যামা থেকে শুরু করে টিমের অন্যরা, সবাই ভীষণ পজিটিভিটি দিচ্ছে আমায়। সবাই বলছে, খুব মিস করছি। এইসব শুনে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি আবার শ্যুটিং করতে যাব।' তবে নিয়ম পালনে কোনও খামতি রাখছেন না নীল। কী কী সাবধানতা নিচ্ছেন? উত্তরে নীল বললেন, ' বাবা-মাকে একদম ঘরে আসতে দিচ্ছি না। ওদের নিয়েই চিন্তা। মা বাইরে থেকে টেবিলে খাবার রেখে দেয়। আমি বাসন পরিষ্কার করে সেটা ডেটল জলে ডুবিয়ে দিই। সরকারের নিয়ম মতো সপ্তাহে একদিন করে লোক এসে বর্জ্য নিয়ে যাচ্ছে। সবসময় মাস্ক, গ্লাভস ব্যবহার করছি।'



কোভিড আক্রান্ত হয়েও বাড়ি শ্যুটিং চালিয়ে যাওয়া কতটা কঠিন? ঠিক কী প্রভাব পড়ছে শরীরে মনে? উত্তরে সবার আগে সতর্কতার কথা তুললেন নীল। বললেন, 'আমার বয়সে কোভিড ততটা ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন সতর্কতা। নাহলে আমার থেকে অন্য কারোও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। প্রথমদিকে শ্যুটিং করতে খুব ক্লান্ত লাগত। মনে হত আর কাজ করতে পারছি না। মনের জোরে অভিনয়টা চালিয়ে যেতাম। তবে পরিস্থিতি ঠিক হলে অবশ্যই সেটে ফিরে কাজ করতে চাই।'



শ্যামার থেকে দূরে রয়েছেন নিখিল। তবে বাস্তবে মায়ের জন্য বড্ড মন খারাপ নীলের। মোবাইল ফোনে বললেন, 'শেষ ১৪দিন একটু মায়ের পাশে বসে শান্তিতে কথা বলতে পারিনি। আমি মা-বাবা তিনজন ৩টে ঘরে বসে ভিডিও কলে কথা বলি। প্রিয় মানুষদের কাছে গিয়ে, কথা বলব, একটু ভালো সময় কাটাব, এটা তো আমরা সবসময়ই চাই।'



প্রতিদিন ঘরের দরজা খুললেই নাকি ভক্তদের পাঠানো ফুল আর চকলেট পাচ্ছেন নীল। হেসে বললেন, 'খুব স্পেশাল ফিল করছি। আমার মনে হয় মানসিকভাবে সবাইকে পাশে পেলে করোনা অর্ধেক সেরেই যায়। আমি পরিচিত বলে হয়ত অনেক বেশি সাপোর্ট পাচ্ছি। তবে আমার মতো ভালোবাসা যদি সমস্ত কোভিড আক্রান্তের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাঁদের লড়াইটাও সহজ হবে।'