কৃষ্ণেন্দু অধিকারী, কলকাতা: সত্য়জিৎ রায় থেকে ঋত্বিক ঘটক। সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায় থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্য়ায়। জীবনানন্দ দাশ থেকে জ্য়োতি বসু কিংবা সুচিত্রা সেন। কেউ নিজে জন্মেছেন বাংলাদেশে। কারও বা পূর্বপুরুষের ভিটে রয়েছে সেখানে। কিন্তু, মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দেওয়ার পর, আঘাত নেমে আসতে শুরু করেছে সেই সব জায়গাতেও। ভেঙে দেওয়া হয়েছে ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি। কিংবদন্তীদের স্মৃতিবিজড়িত বাকি ঘরবাড়িগুলো অক্ষত থাকবে তো? আশঙ্কা দানা বাঁধছে এপাড়ে।
'যব ছোড় চলে লখনউ নগরি, কহো হাল আদম পর কেয়া গুজরি'। লখনউ থেকে নির্বাসনের পরোয়ানা পেয়ে বিখ্যাত এই ঠুমরিটি গেয়ে উঠেছিলেন অওধের শেষ স্বাধীন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। ভিটেমাটি যাঁদের ছাড়তে হয়, একমাত্র তাঁরাই বোঝে সেই যন্ত্রণা কী! আজ বাংলাদেশে হিন্দু ভাই-বোনেদের ওপর অত্য়াচারের এই সব ছবি দেখে এপারের নাগরিকরা যেমন ক্ষুব্ধ, তেমন আহত। কারণ, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র ঠিকই। কিনতু, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা কোনওদিনই কাঁটাতারের এপার-ওপারের নয়। বরং সম্পর্কটা বরাবরই আবেগের। এপাড়ে যে শিল্প-সংসকৃতি আজ ডালপালা মেলেছে, তার শিকড় তো লুকিয়ে ওপাড়েই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্য়ায় থেকে ঋত্বিক ঘটক, সত্য়জিৎ রায়। কারও পূর্বপুরুষ, কারও নিজেরই জন্ম বাংলাদেশে। কিন্তু, হিংসার আগুন কি আর আবেগ চেনে? মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দেওয়ার পর প্রথম কোপ পড়েছে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক ভিটেতে। রাজশাহীর ঘোড়ামারা মহল্লার যে বাড়িতে থেকে ঋত্বিক ঘটক পড়াশোনা করেছেন... শীতকালের সাহিত্য-সঙ্গীত সম্মেলন উপলক্ষে যে বাড়িতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণীদের আনাগোনা লেগে থাকত বহু স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
যে মানুষটা দেশভাগের যন্ত্রণায় তিলে তিলে শেষ হয়ে গেলেন, তাঁর বাড়িকেও রেহাই দিল না বাংলাদেশ! সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায়ের জন্ম বাংলাদেশের মাদারিপুরে। সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায়ের স্মৃতিবিজড়িত পাঠাগার ছিল ওই বাড়িতে। যাঁর অর্ধেক জীবন, পূর্ব-পশ্চিম উপন্য়াসজুড়ে বাংলাদেশের ছায়া, তাঁর ভিটেও দখল হয়েছে বলে খবর এসে পৌঁছেছে সাহিত্য়িকের পরিবারের কাছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, 'উনি বাংলাদেশে গিয়ে জমি কিনে বাড়ি করলেন। একটা ঘরে সুনীলের কিছু জিনিসপত্র ছিল। আরেকটা ঘরে দাতব্য চিকিৎসালয় করেছিলেন সুনীল। আমরা গিয়ে ছিলাম, খুব আদর যত্ন পেয়েছি। কিন্তু তখনই কয়েকজনের কাছ থেকে বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। ওরা হয়তো ঠিক নিতে পারছে না। ওখানকার কেউ শুনেছে, তারপরে বলেছে। তারাই বলল, 'আপনাদের বাড়িটা দখল হয়ে গিয়েছে।'
বাংলাদেশের পাবনায় জন্ম রমা দাশগুপ্তর। ভুবন ভোলানো হাসির জন্য়, যাঁকে পরবর্তীকালে গোটা দুনিয়া চিনেছিল সুচিত্রা সেন নামে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জন্ম ময়মনসিংহে। জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন বরিশালে। মৌলবাদীদের রোষ থেকে সেইসব জায়গা রক্ষা পাবে তো? দানা বাঁধছে আশঙ্কা। সত্য়জিৎ রায়ের ছেলে, সন্দীপ রায় বলছেন, '১৯৮৭ সালে যখন বাবা সুকুমার রায়ের ডকুমেন্টরিটা করলেন, সুকুমার রায়ের ১০০ বছর উপলক্ষ্যে, উনি চেয়েছিলেন ওখানে গিয়ে বাড়িটায় শ্যুটিং করতে। উনি ওঁর প্রোডাকশন কন্ট্রোলার অনিল চৌধুরীকে পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশে। অনিলবাবু বাংলাদেশে গিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে আনেন। সেই ছবি দেখে বাবা খুব মর্মাহত হয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালের যে অবস্থা তার থেকে বেশি কিছু উন্নতি হবে বলে মনে করছি না। জিনিসটা অক্ষত থাকলে ভাল হত।'
বাংলাদেশের বারদী গ্রামে জ্য়োতি বসুর আদি বাড়ি। ২০১৮ সালে সেখানে পৌঁছেছিল এবিপি আনন্দ। সেই বাড়ি রক্ষা করা যাবে তো? ১৯৬৪ সালে ঋত্বিক ঘটক লিখেছিলেন, 'আজকে বাংলাদেশে আমরা গুন্ডামি করি, আমরা ধর্মবিদ্বেষ প্রচার করি; এত বছরের আন্দোলন এইখানে এসে পর্যবসিত হচ্ছে, এ যে কত বড় মর্মান্তিক ব্যাপার তা ভাবতে আমার কষ্ট লাগে। এই বাংলা দেশের তথ্যচিত্র যদি আমাকে তুলতে বলা হয়, আমি তুলবোই না মশাই। দেশটি ক্রমশই ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর কোনও সৎ শিল্পীরই নিজের দেশকে ইতর বলে দেখানো উচিত না। ব্যাপারটা অধার্মিক।'
দিল্লি যখন জ্বলছে তখন মির্জা গালিব আক্ষেপে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর শহর। প্রিয় দিল্লি হে আমার, তুমি এখন শুধুই মৃত্যুর শহর।’ আজ ঋত্বিক বেঁচে থাকলে কী বলতেন?
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।