কলকাতা: 'তাহলে? কবে আসছিস?'


'এই তো বিদেশে একটা ছোট্ট শ্যুটিং আছে, ওটা শেষ করেই...'।

ওয়েবসিরিজ নিয়ে মিটিং শেষ করে বেরোনোর সময় এটাই ছিল শেষ কথা। পাকা হয়ে গিয়েছিল শ্যুটিং-এর দিনও। কেবল বাকি ছিল পোশাকের মাপ নেওয়া।

'ঝিন্দের বন্দি'-র পর ফের একটি নেতিবাচক চরিত্র নিয়ে উচ্ছসিত ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত পড়ে রইল সখের চরিত্র, স্যুট পরার ইচ্ছা। চলে গেলেন কিংবদন্তি। অসমাপ্ত সেই কাজ নিয়ে মুখ খুললেন রুদ্রনীল ঘোষ।

'প্রথম ওয়েবসিরিজ আর নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয়। কাজটা নিয়ে সৌমিত্রজেঠুর সঙ্গে কথা বলার সময় একটু দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তাঁরও বেশি সহযোগিতা পেয়েছিলাম ওনার থেকে', বললেন রুদ্রনীল। ওয়েবসিরিজ 'গঙ্গা' তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এই প্রথমবার ড্রাগ মাফিয়ার ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পেতেন দর্শক। মোবাইল ফোনে এবিপি আনন্দকে রুদ্রনীল বললেন, 'স্ক্রিপ্টটা নিয়ে উনি এত উৎসাহী ছিলেন যে, নিজেই বারবার ফোন করে খবর নিতেন। শুধু তাই নয়, বিশেষভাবে চিত্রনাট্যের এক একটা ভাগ নিয়ে আলোচনা করতে চাইতেন। বলতেন, আচ্ছা, আমি যদি ধুতি না পরে স্যুট পরি তাহলে আমায় আরও বেশি মানাবে। ওনার মধ্যে সদ্য অভিনয়ে আসা যুবকের মতোই খিদে ছিল। আমরা সবসময় ভাবতাম, স্ক্রিপ্টে আরও কী কী রাখলে ওনার মনের খোরাক মেটানো যাবে।'

করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও কাজ করেছেন সৌমিত্র। রুদ্রনীল বলছেন, 'আমি বলেছিলাম, জেঠু তুমি এখনও কাজ করছো, টেনশন হচ্ছে না! উনি বললেন, কাজ বন্ধ করে দিলে একজন শিল্পীর আর কী থাকে? কাজ বন্ধ করে দিলে কি করোনা হবে না! তুই স্ক্রিপ্টে খালি বেশি দৌড়ঝাঁপের দৃশ্য রাখিস না।'

'গঙ্গা' ওয়েবসিরিজ নিয়ে বৈঠক করে বেরিয়ে আসার পর শেষ ছবি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ না করার আফশোস রয়ে যাবে রুদ্রনীলের। সেই সঙ্গে রয়ে যাবে দীর্ঘদিন পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে একেবারে অন্য ভূমিকায় না দেখার আক্ষেপ। অভিনেতা বলছেন, 'সৌমিত্রজেঠু ফ্লোরে থাকলে সেখান থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া যেত। এত মাটির কাছের মানুষ ছিলেন, কখনও বুঝতে দিতেন না বাংলা ছবির কৌলিন্যকে উনি একাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি লন্ডনে থাকাকালীন ফোনে কথা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, 'তুই পুজোর মধ্যে ফিরে এলে তখনই বসতে পারি কাজটা নিয়ে।' আমি ফিরে আসার পর শুনি উনি অসুস্থ। তখনও ভেবেছিলাম, তাহলে শ্যুটিং-এর দিন পিছিয়ে দেব। ওনার বিশ্রাম দরকার।'

'বর্তমান প্রজন্মের কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন আদর্শবান চরিত্র। তাঁকে সেভাবেই অভিনয় করতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন সবাই। বহুদিন পর কলকাতার একটা অন্ধকার জগতের কথা পর্দায় উঠে আসত। যে জগতের ডন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,' রুদ্রনীলের গলায় বারবার উঠে আসছে অতৃপ্তির কথা। ফের বললেন, 'এই ছবিটা আবার শুরু করলে সৌমিত্রজেঠুকে উৎসর্গ করব।'

রবীন্দ্রসদন থেকে ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশান অবধি দীর্ঘ মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন রুদ্রনীল। বাড়ি ফিরেও চোখের সামনে ভাসছে সেই জনস্রোতের ছবি। ফোন রাখার আগে ধরা গলায় বললেন, 'হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম, অনেক মানুষ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে প্রণাম করছেন, কাঁদছেন। কেবল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নয়, আজ সবার আবেগ, বাংলা ছবির আভিজাত্য শেষ যাত্রায় যাচ্ছিল।'