কলকাতা: ১৩ মে মুক্তি পাচ্ছে অনীক দত্ত (Anik Dutta) পরিচালিত 'অপরাজিত' (Aparajito)। ছবিতে জিতু কামালের (Jeetu Kamal) প্রথম লুক (first look) প্রকাশ পেতেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) আদলে তৈরি তাঁর চরিত্রের পাশাপাশি নজর কেড়েছে সায়নী ঘোষের (Saayoni Ghosh) লুকও। ছবিতে তিনি জিতু অভিনীত চরিত্র অপরাজিত রায়ের স্ত্রী, বিমলা রায়। সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়ের (Bijoya Ray) আদলে তৈরি হয়েছে তাঁর চরিত্র। এক অর্থে এটি সায়নীর 'কামব্যাক' ছবি। কেমন ছিল সায়নী ঘোষ থেকে বিমলা রায় হয়ে ওঠার সফরটা? এবিপি লাইভকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত জানালেন অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ।
প্রশ্ন: কীভাবে এই চরিত্রের অফার আসে?
সায়নী ঘোষ: অনীক দত্তের সঙ্গে আগে আমি 'মেঘনাদ বধ রহস্য'-এ কাজ করেছি। তার অনেক বছর আগে একটা বিজ্ঞাপনেরও কাজ করেছি। সেই সূত্রে আমাদের অনেকদিনের আলাপ। এই ছবির জন্য হঠাৎই একদিন অনীক দা ফোন করেন। আর সেই সময়ে আমি রাজনীতিটাই একটু বেশি মন দিয়ে করছি। ছবি করা তখনও শুরু করিনি। অনীক দা সেই সময়ে ফোন করে জানান যে, এমন একটি ছবির পরিকল্পনার আছে, অনেকেরই লুক টেস্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয় যে তুমি এই চরিত্রটা ভাল ক্যারি করতে পারবে।
তারপর অনীক দা বলেন যে আমরা একটা লুক সেট করব, স্ক্রিপ্ট রিডিং সেশন হবে, তারপর একটা ছোট্ট অডিশন নেব। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলেই পরের ধাপ। তারপর খুব ভাল করেই অডিশন হল, বিশেষ কিছু করাননি আমাকে দিয়ে। তিনবার স্ক্রিপ্টটা পড়িয়েই বললেন 'একদম ঠিক আছে।' এরপর লুক সেট করে দেখা গেল জিতুর সঙ্গে বেশ ভাল মানাচ্ছে। তারপরই কাজ এগোল।
প্রশ্ন: অভিনয় থেকে কিছুদিন বিরতির পর এই ছবি আপনার সেই অর্থে 'কামব্যাক'...
সায়নী: একদম। প্রথমত, কামব্যাক ছবির জন্য অনীক দার থেকে ফোন পাওয়া, সেটাই খুব আনন্দের ছিল। তার ওপর বিজয়া রায়ের মতো একজনের চরিত্র, একজন ওরকম কিংবদন্তি, সিরিয়াস মানুষ, এবং একটা চরিত্র যাঁর সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের তুলনায় আমাদের অনেকটা কম জানা আছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অফারটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিজয়া রায় নিজে একজন শিক্ষিত, প্রগতিশীল, আধুনিক, সাহসী মানুষ ছিলেন যিনি বাংলার সঙ্গে খুব ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন। একাধিক জায়গায় অনীক দা বলেছেন পরে যে আমাকে নেওয়ার অন্যতম কারণ খুব কম অভিনেত্রীই আছেন যাঁরা একসঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি দুটোই খুব ভাল বলতে পারেন। ছবিতে আমার মুখে বেশ কিছু বড় বড় ইংরেজিতে সংলাপ আছে। এছাড়া লুক সেটের দিনও আমি বলি অনীক দাকে যে আমি প্রায় এক বছর পর ক্যামেরা ফেস করব। প্লিজ ভুল হলে ক্ষমা ঘেন্না করে দিও। (হাসি)
প্রশ্ন: জিতুর লুক প্রকাশ পেতেই প্রায় ভাইরাল হয়ে যায়। তারপর আপনার লুকও বেশ নজর কাড়ে।
সায়নী: দেখুন, বিজয়া রায়কে সেই অর্থে আমরা কিন্তু অত দেখিনি। মানে সত্যজিৎ রায়ের নাম বললেই যেমন বাঙালির মনে ভেসে ওঠে তাঁর মুখ, বিজয়া রায়ের ক্ষেত্রে সেটা একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। মানে নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো আমাকে দেখে এখন গুগলে বিজয়া রায় টাইপ করে খুঁজছে। লুক সেটের পরে সেটাই চ্যালেঞ্জ ছিল যে মানুষ চিনতে পারছেন কি না। তবে সেটার ওপর যে আমরা খুব নির্ভর করেছি তা নয়। কারণ ছবিতে যে সময়টা তুলে ধরা হয়েছে, 'পথের পাঁচালী'র শ্যুটিংয়ের সময়টা, যখন ওঁদের সবে বিয়ে হয়েছে, সেই সময় নিয়ে লোকের ধারণা অনেক কম। ফলে আমরা নিজেদের ইনপুট নিয়েই কাজ করেছি।
প্রশ্ন: তাহলে এই চরিত্রের জন্য নিজেকে তৈরি কীকরে করলেন?
সায়নী: আমি তো সারাক্ষণ অনীক দাকে বলতাম যে কী করব, কী করব। তখন উনি বোঝালেন যে দেখো, এটার দুটো দিক আছে। এক ওঁর সম্পর্কে আমরা ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম। ওঁর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের কেমন সম্পর্ক ছিল, কিছু বিশ্বাসযোগ্য গল্প পড়ে, এবং সন্দীপ দার (সন্দীপ রায়) কাছ থেকে যতটা পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়ে কাঠামো তৈরি করা। একইসঙ্গে যেহেতু খুব বেশি তথ্য নেই, তাই আমাদের মতো এই চরিত্রটি করার স্বাধীনতা আমাদের রয়েছে। মানে কোনও পরিস্থিতিতে বিজয়া রায় কেমন প্রতিক্রিয়া দিতেন, কীভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন, কেমন তাঁদের সম্পর্ক ছিল, তাঁর যে ওই কঠিন, দৃঢ় একটা ইমেজ, সত্যজিৎ রায়ের প্রত্যেকটা কাজ, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবেতে তাঁর একটা মতামত থাকত, এইরমক ব্রিফ আমাকে দেওয়া হয়েছিল।
অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমরা দৃশ্য অনুযায়ী অভিনয়ের মাত্রা নির্ধারণ করতাম। অভিনেত্রী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, জিতু আমাদের কাছে এমন রিফ্রেশিং একটা চেঞ্জ, সেখানে আমি বেশি অভিনয় করে ফেললে গোটা ব্যাপারটা বেমানান হয়ে যেত। বরং আমার ওর চরিত্র ও অভিনয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঁর পরিপূরক হিসাবে কাজ করা উচিত বলে মনে করেছি। এবং সেই চেষ্টাই করেছি। যাতে পর্দায় আমরা একে অপরের সঙ্গে চলেছি সেটাই মনে হয়।
প্রশ্ন: জিতু কামালের সঙ্গে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কেমন?
সায়নী: ভীষণ ভাল। জিতু খুব ভাল, খাঁটি এবং মনোযোগী একজন অভিনেতা। অনেকদিন পর এমন একজন অভিনেতাকে দেখালাম যে শ্যুটিং যখন করছে না তখনও চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে এবং সেটা নিয়েই ভাবছে। চরিত্রটা জিতু এতটাই সিরিয়াসলি করেছে যে শ্যুটিং শেষ হতে হতে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হত সত্যজিৎ রায় হাঁটছেন। মানে ও ওই ম্যানারিজমটা এমনভাবে রপ্ত করে ফেলেছিল। এই ছবিটা জিতুর জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ভবিষ্যতেও কতটা গুরুত্ব বহন করবে, সেই সিরিয়ানেসটা জিতু দেখিয়েছে। ফলে আমি মনে করি, যে কঠিন পরিশ্রমটা জিতু করেছে এবং অবশ্যই অনীক দার মতো একজন মেন্টরের গাইডেন্সে ও অনেক দূর যাবে।
প্রশ্ন: বেশ কিছুদিন পর আবার অভিনয়ে ফিরছেন, তাও অনীক দত্তের হাত ধরে। অভিজ্ঞতা কেমন?
সায়নী: দুর্দান্ত। আমাদের সম্পর্ক রাজনীতির ঊর্ধ্বে। আমরা সকলেই জানি, অনীক দত্ত একজন দৃঢ় মতামত সম্পন্ন ব্যক্তি। সেখানে দাঁড়িয়ে আমিও তাই। কিন্তু শিল্পের সৌন্দর্য্য বোধ হয় এখানেই যে না অনীক দা কখনও নিজের রাজনৈতিক বা সামাজিক ধারণাগুলোকে আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, না কখনও সেটা আমি করেছি। এবার শ্যুটিংয়ের মাঝে আমি আর অনীক দা গল্প করছি হয়তো, দেখতাম আশেপাশে কেউ খুব স্বাভাবিক কারণে হালকা হাসছে, বা তাকিয়ে দেখছে। সেটা একটা দিক ছিল। কিন্তু সত্যি বলতে, আমি যখন ভোটেও লড়েছি, এবং কোথাও প্রচারে গিয়ে কোনও যদি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটত, তাহলে আর কেউ করুক না করুক, অনীক দার থেকে মেসেজ পেতাম যে 'তুমি ঠিক আছ তো?' আসলে আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলেও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে সেটা প্রভাব ফেলেনি। আমরা বহুদিনের সহকর্মী, রাজনীতি আমাদের শিল্পকে ছাপিয়ে যায়নি।
আরও পড়ুন: Jeetu Kamal Exclusive: রাতে ঘুম আসত না, সত্যজিৎ রায়ের কণ্ঠস্বর কানে ভাসতে থাকত: জিতু কামাল
ফলে এবারও আমরা খুব ভাল কাজ করেছি। তাছাড়া আমি অভিনেত্রী হিসেবে খুবই বাধ্য। অনেকেই বলেন অনীক দা একটু অল্পেতে রেগে যান। কিন্তু আমার সঙ্গে অনীক দার সঙ্গে আমার বরাবরই ভাল সম্পর্ক। কিচ্ছু বদলায়নি, বরং এবারে কাজের অভিজ্ঞতা আগের তুলনায় অনেক বেশি ভাল।
প্রশ্ন: শ্যুটিংয়ে রাজনৈতিক আলোচনা হত তার মানে?
সায়নী: (হাসি) সেটা তো সারাক্ষণই হত। তবে এই ছবির শ্যুটিংয়ের একটা খুব চাপ ছিল। সত্যজিৎ রায় যখন 'পথের পাঁচালী' করেছিলেন, সেই সময় তিনি যা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, অতটা না হলেও আমাদেরও এই ছবির কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ পেরোতে হয়েছে। একে তো এতজনের একটা কাস্টিং, আর সেই সময়ে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছে। কাশবন ধুয়ে যাচ্ছে। আজকে জানি শ্যুটিং হবে, কাল শুনছি হবে না। আমার পুরোদমে ভোটের প্রচারপর্ব চলছিল। মানে একটা ক্যাম্পেন সেরে শ্যুটিং যাচ্ছি। গিয়ে হয়তো শুনছি সেটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। আবার সেখান থেকে অন্য ক্যাম্পেনে ছুটছি। তার মধ্যে আমি গ্রেফতার হই, সেই কারণে শ্যুট বাতিল করতে হয় অনীক দাকে। মানে আমি বাবা-মাকে ফোন করার আগে, অনীক দাকে ফোন করে জানাই সেই কথা। এরপরে অনেক সময়েই অনেক আলোচনার পরে অনীক দা বলতেন, 'শোনো আবার কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে না যেন।' মানে 'আমার শ্যুটিংটা শেষ করো বাপু'। (হাসি) দেখুন, রাজনীতি তো আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে আলোচনা টুকটাক হবেই, কিন্তু সেই নিয়ে সমস্যা কোনও হয়নি কখনও। কিন্তু সেটে আমি একজন অভিনেত্রী এবং উনি আমার পরিচালক। সেই সম্পর্ক সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সত্যি বলতে, এটা আমার একটা কামব্যাক ছবি। ফলে আমি অনেক বেশি সিরিয়াসনেস নিয়ে কাজ করেছি। সেই সঙ্গে ছবির বিষয়টাও এমনই যে তার সমস্ত সিরিয়াসনেসটা প্রাপ্য। এবং 'অপরাজিত'র মতো একটা ছবি তৈরির জন্য দুঃসাহসিকতা লাগে। সেটা আমাদের প্রযোজক ও পরিচালক দেখিয়েছেন। আমরা সকলে খুব খেটে কাজটা করেছি। আশা করছি সকলের ছবিটা খুব ভাল লাগবে।