কলকাতা: ঠাসা ক্লাসরুম। ব্ল্যাকবোর্ডে শব্দে ১ থেকে ৯ লিখে চলেছেন প্রধানশিক্ষক। পড়ুয়ারা দেখছে। কিছুক্ষণ পরে শিক্ষক গিয়ে এই লেখাগুলোর কিছু কিছু অংশ মুছে দিলেন। আর তাতেই সংখ্যায় পরিণত হল ১ থেকে ৯। প্রধানশিক্ষকের নাম যোগেশচন্দ্র দত্ত। স্কুলের নাম বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। আর বেঞ্চে ছাত্রদের ভিড়ের মধ্যে থেকে তন্ময় হয়ে লেখা আর মোছার এই খেলা দেখছে এক খুদে পড়ুয়া- নাম সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)। যিনিই পরে হয়ে উঠবেন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক, শিশু-কিশোর সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এখনও বাঙালি পাঠককুলের শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণের বড় অংশ সত্যজিৎময় হয়ে থাকে। এর বাইরে বিজ্ঞাপনের জগতেও অবিস্মরণীয় নাম সত্যজিৎ রায়। বাঙালি হাতেগোনা যে কজনকে নিয়ে আজীবন গর্ব করতে পারে, তাঁদের একজন মানিকবাবু। যাঁর কাজের সীমানা আর গভীরতা বোঝা এক জীবনে কার্যত অসম্ভব। সত্যজিৎ রায়ের গল্প-উপন্যাস, সিনেমা-তথ্য়চিত্র নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। অনেকবার আলোচনায় উঠে এসেছে সিনেমার পোস্টার তৈরির সময় তাঁর অবদানের কথা। নিজে হাতে একাধিক সিনেমার পোস্টার তৈরি করেছেন তিনি। তৈরি করেছেন বইয়ের কভারের প্রচ্ছদও। যার প্রায় সবকটিই কালজয়ী। দর্শকদের-পাঠকদের মনে গেঁথে রয়েছে। এগুলি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে এসে যাবে সত্যজিৎ রায়ের শিল্পীসত্ত্বার আরও একটি দিক- ক্যালিগ্রাফি এবং তার সঙ্গেই টাইপোগ্রাফি। শুরুতে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে, 'যখন ছোট ছিলাম'- বইয়ে স্কুল জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সেই ঘটনারই বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন খোদ সত্য়জিৎবাবু। হয়তো এই ঘটনাই সেই ছোটবেলাতেই তাঁর মনে ক্যালিগ্রাফির (Calligraphy) বীজ বপন করেছিল।
প্রাচীনকালের ভাষা, সুপ্রাচীন লিপির যা যা ছবি আমরা দেখি। তার প্রায় সবটাই চিহ্ন বা ছবি। তার মাধ্য়মেই মনের ভাষা প্রকাশ করতেন সেই সময়ের নাগরিকরা। কতকটা যেন তারই ধারা বয়ে আসে অক্ষরের চেহারা-বিন্যাসেও। বিভিন্ন ধাঁচে লেখা। তার ডিজাইন, তার শেড- আরও নানা কিছু। হয়তো কোনও নাম বা কোনও শব্দের ভাবপ্রকাশ বা প্রভাবের মাত্রা বদলে বদলে যায় কলমের আঁচড়ে কেমন ডিজাইন ফুটে উঠছে তার উপর নির্ভর করে। বিজ্ঞাপন জগতে কাজের অভিজ্ঞতা হয়তো সমৃদ্ধ করেছিল সত্যজিৎ রায়কে। তাঁর সৃষ্টি কল্পনার রথ হয়তো সেখান থেকেই রসদ পেয়েছিল। বিভিন্ন কায়দায়, বিভিন্ন বিভঙ্গে এক একটা অক্ষরকে সাজিয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎবাবু। আর তাঁর হাত ধরেই বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে বিপ্লব এসেছে। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসের প্রচ্ছদগুলি ক্যালিগ্রাফির অসামান্য সৃষ্টির পরিচয় দেয়। শুধু সেটাই নয়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গুপি গাইন-বাঘা বাইনের প্রচ্ছদ যেন ওই দুই চরিত্রকেই জীবন্ত করে তুলেছে। বাংলার প্রবাদপ্রতিম কবি-সাহিত্যিকের বইয়ের মলাটের প্রচ্ছদও ধরে রেখেছে সত্য়জিৎ রায়ের ক্যালিগ্রাফির অসামান্য নানা কীর্তি। সেই তালিকায় রয়েছে জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, লীলা মজুমদার-সহ আরও অনেকের বইয়ের প্রচ্ছদ।
সন্দেশ থেকে এক্ষণ...
ক্যালিগ্রাফির কথা বলতে গেলে আসবে সন্দেশ-এর নাম। বাংলা শিশু-সাহিত্য জগতে একটি মাইলস্টোন সন্দেশ পত্রিকা। ১৯১৩ সালের উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর হাত ধরে শুরু হয় এর পথ চলা। তারপরে সুকুমার রায়ের হাতে ছিল এই পত্রিকার ভার। পরে সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে নতুন করে শুরু হয় এর যাত্রা। ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুর মতো চরিত্রও পাঠক প্রথম পেয়েছিল সন্দেশে। এই পত্রিকার আরেকটি পরিচয় ছিল এর মনকাড়া প্রচ্ছদ। চলতি বছরেই ১১০ বছর পূর্তি হয়েছে সন্দেশ পত্রিকার। সেই উপলক্ষে একটি ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে জায়গায় পেয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন সন্দেশের অবিস্মরণীয় প্রচ্ছদগুলি।
পত্রিকার কথা যখন উঠল, তখন বলতেই হবে এক্ষণ পত্রিকার কথাও। সৌমিত্র চট্টোপাধ্য়ায় এবং নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত এই পত্রিকা গল্প-প্রবন্ধের জন্য তো মনে রাখা হয়। তবে তার সঙ্গে রয়েছে আরও একটি কারণ। সত্যজিৎ রায়ের তৈরি প্রচ্ছদ। যে কটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, তার সবকটিরই প্রচ্ছদ একেঁছেন তিনিই। আর সবকটিই তাঁর ক্যালিগ্রাফির অসামান্য সব নমুনা। বারবার নানা ভাবে এ, ক্ষ এবং ণ- এই তিনটি অক্ষর নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা, ভাঙাগড়া চালিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। এক এক সময় এক একরকম ভাবে ফুটে উঠেছে পত্রিকার নাম। বাংলা সাহিত্যজগতে এক্ষণ-এর নাম থেকে যাওয়ার জন্য এই প্রচ্ছদগুলির অবদান কোনও অংশেই কম নয়। বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মান হয়তো নন্দন পেয়ে থাকে। এই প্রেক্ষাগৃহের নামকরণ ও লোগো তৈরি সত্যজিৎ রায়েরই হাতে। সত্যজিৎ রায় কথার বুনোটে গল্প যেমন লেখেন, তেমনই ছবিতেও যে গল্প তৈরি করেন-তার অন্য়তম উদাহরণ 'যখন ছোট ছিলাম'। ছোটবেলার স্মৃতির কত অংশ তাঁর স্কেচেই যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বলে মনে হয়। কর্মজগতে এবং তার আগে শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, নন্দলাল বসুর প্রভাবে জারিত হয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তার সঙ্গে মিশেছে তাঁর অকৃত্রিম এবং অনবদ্য শিল্পীসত্ত্বা। এগুলিরই স্ফুরণ হয়েছে তাঁর ক্যালিগ্রাফি এবং টাইপোগ্রাফিতে।
ইংরেজি ফন্টেরও স্রষ্টা:
বাংলায় তো বিভিন্ন নির্দশনের কথা জানাই রয়েছে। আলোচনাও রয়েছে। বাংলার মানিকবাবু ইংরেজিতেও চারটি ফন্ট তৈরি করেছিলেন। প্রতিটিই ইতিহাসজয়ী। Ray Roman, Ray Bizarre, Daphins, Holiday Script---এই চারটি নামের ফন্ট সৃষ্টি হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের হাতে। এর মধ্যে ২টি ফন্ট তাঁকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও এনে দেয়।
'যখন ছোট ছিলাম'-এর এক জায়গায় সত্যজিৎ রায় লিখছেন, ছোটবেলায় একবার তিনি মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে বেগুনি রঙের ছোট্ট একটি অটোগ্রাফের খাতা। উত্তরায়ণে গিয়ে কবিগুরুর কাছে আবদার করেছিলেন একটি সইয়ের জন্য। সেদিন সঙ্গে সঙ্গে সই দেননি কবিগুরু। কথামতো পরদিন যেতেই ছোট্ট সত্যজিতের দিকে খাতাটা এগিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকবি। সেই খাতার পাতায় ছিল- একটি শিশিরবিন্দু কবিতার গোটাকতক লাইন। রবিঠাকুর তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে কী দেখেছিলেন জানা নেই। কিন্তু সত্যিই তো বিদেশ ঘুরে দেশেই ফিরেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাংলার গ্রামের সহজ জীবন নিয়ে কালজয়ী সিনেমা বানিয়েছেন। সৃষ্টি করেছেন অমর সাহিত্য। আর প্রতিপদে তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে অসামান্য সব প্রচ্ছদ- যার অনেকগুলিরই তুলির আঁচড়ে দেশের মাটির ঘ্রাণ, বাংলার শিশিরের গন্ধ।
তথ্যসূত্র:
১. ১৪০৮ সালে প্রকাশিত সন্দেশ পত্রিকার বিশেষ সত্য়জিৎ সংখ্যা
২. যখন ছোট ছিলাম- সত্যজিৎ রায়
আরও পড়ুন: এই পেঁয়াজ কাটলেও চোখে আসে না জল! রয়েছে আরও গুণ, জেনে নিন কী কী?