কলকাতা: কিছু দিন আগেই শাঁওলি মিত্রের (Shaoli Mitra) সঙ্গে হোয়াটসঅ্য়াপে শেষ কথা হয় নাট্য ব্যক্তিত্ব সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Surojit Bandypadhyay)। কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেছিলেন, 'ভাল নেই রে'।


রবিবার বিকেলে নীরবে চলে গেলেন বাংলা নাট্য জগতের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী শাঁওলি মিত্র। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কন্যা শাঁওলি মিত্র। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী, অনাড়ম্বর ভাবে গতকাল বিকেলেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় সিরিটি শ্মশানে।


তাঁর প্রয়াণে শোকের ছায়া নাট্য জগতে। শোকস্তব্ধ অপর নাট্য ব্যক্তিত্ব সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। শাঁওলি মিত্র তাঁকে 'বাপি' বলে ডাকতেন। দুঃসংবাদ পাওয়ার পর এদিন হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট খুলে দেখছিলেন সুরজিৎ বাবু। বলছেন, 'তার আগেই লিখেছিলেন দেখছি, মায়ের যে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলি বাপি সেগুলি উড়ে গেছে। আরেকবার পাঠাতে পারবি? শেষদিন পর্যন্ত এরকম যোগাযোগ ছিল।'


কোথায় তাঁর সঙ্গে আলাপ প্রথম? 'প্রথম শুরুটা হয়েছিল, রেডিও নাটকে উনি অনন্যা ছিলেন। "কোনি" যে ছবি এত বিখ্যাত, সেই কোনির প্রথম রেডিও নাটকে অভিনয় করেছিলেন শাঁওলি মিত্র। সে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। সেই থেকে শাঁওলি দির প্রতি একটা প্রেম জন্মায়। ওঁর কণ্ঠস্বর, ওঁর প্রেমের অভিনয়, পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর থিয়েটার। "নাথবতী অনাথবত্‍" দেখে প্রত্যেকের মতো আমিও মুগ্ধ হই। এবং "কথা অমৃত সমান"-এ সরাসরি চিত্র পরিচালক গৌতম হালদারের মাধ্যমে শাঁওলি দির সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। এবং সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ওই নাটকের নেপথ্যে অনেক কাজকর্ম আমি করে থাকি। তারপর ধীরে ধীরে 'তুমি' থেকে 'তুই'-এ ট্রান্সফার করে নেন। শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে বাপি, তুই বলেই কথা বলতেন।'


নিজের নাট্য জীবনের এক অভিজ্ঞতা ভাগ করলেন সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি একবার শম্ভু মিত্রের চরিত্রে একটি নাটক করেছিলেন। তাঁর কথায়, 'বড় মানুষের স্তাবক থাকে তো! শম্ভু মিত্রের অনেক স্তাবক আমার সেই নাটক বয়কট করেছিলেন। দেখেননি। সকলে ভেবেছিলেন শাঁওলি মিত্রও হয়তো বাধা দেবেন। কিন্তু উনি বাধা তো দেননি, উল্টে আমার অনুরোধে নাটকটি দেখতে এসেছিলেন।'


আরও পড়ুন: Shaoli Mitra Passed Away: প্রয়াত নাট্য ব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্রকে শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ উদ্যোগ রাজ্য সরকারের


নাটকটি দেখে উদার কণ্ঠে প্রশংসাও করেছিলেন শাঁওলি মিত্র। সুরজিৎ বাবুর কথায়, 'তিনি বলেন, আমি বিস্মিত যে বাবাকে নিয়ে এরকম একটা নাটক হল, যে নাটকে রাজনৈতিক চুটকি নেই, সাম্প্রতিক রাজনীতিকে ব্যঙ্গ করা নেই, এমন কিছু নেই যাতে মানুষ রসগ্রহণ করতে পারে। অথচ এমন এমন নাম, এমন এমন রাজনৈতিক পটভূমিকা আসছে যা এই সময়কার মানুষের ততটা কাছের নয়। তৎসত্ত্বেও তাঁরা এমন পিন পতন স্তব্ধতায় নাটকটি দেখল কীকরে!'


এরপর সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় নিজেই প্রসঙ্গ তোলেন। স্মৃতি রোমন্থন করে সুরজিৎ বাবু বলছেন, 'এরপর তিনি বলেন তোর অভিনয় সম্পর্কে জানতে চাইবি না?' সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় ক্ষমতার প্রশংসা করে শাঁওলি মিত্র বলেন, 'আমার এক সাহায্যকারিণী সঙ্গে গিয়েছিল। সে বাবার অনেক ক্লিপিংস দেখেছে। তোর নাটক দেখা শেষে আমার হাত ধরে সে বলল "দিদি তোমার বাবাকে আজ চাক্ষুষ করলাম"। এটা মুক্ত কণ্ঠে আমাকে বললেন। এটা আমার কাছে প্রায় 'সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড'-এর মতো।'


সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন, 'আমার মনে হয় তিনি যদি অভিনয়টা বন্ধ না করে আরও ভিন্ন ভিন্ন পরিচালকের নির্দেশনায় অভিনয় করতেন... তাঁর প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেনি বলে আমার বিশ্বাস। কেউ কেউ তাঁকে 'লিমিটেড অ্যাক্ট্রেস' বলেন। বলেন যে একটা রাবীন্দ্রিক ঘরানার মধ্যে যেন তাঁর অভিনয় নিহিত। কিন্তু তা যে নয়, যাঁরা সেই সময়ে "বিবিধ ভারতী"তে শাঁওলি দির অভিনয় শুনেছে তাঁরা বলতে পারবেন যে তিনি কত রকমের চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন। তিনি এই সময়ের একজন অন্যতম সেরা অভিনেত্রী ছিলেন। তাঁর অভিনয় করা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা বাংলা থিয়েটারের এক অসামান্য ক্ষতি বলে আমার মনে হয়।'