পৃথা দাশগুপ্ত, কলকাতা: সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ভারত নিশ্চয়ই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অন্য যেকোনও দেশকে টক্কর দিতে পারে। আবার গুণগত মান বজায় রাখার অন্তরায় বোধ হয় সেই সংখ্যাই। একগুচ্ছ সিরিজ (Series) সিনেমা (Movies) মুক্তি পাচ্ছে প্রতি শুক্রবার। নামজাদা পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীরা কাজ করছেন 'হেভি বাজেট'-এর (Heavy Budget) সিরিজে। বেশিরভাগ সিরিজই রহস্য নির্ভর। তাই থ্রিলারের (Thriller) সমস্ত মশলাও মজুত থাকছে। কিন্তু মনে দাগ কাটতে পারছে কি? নাহ! দর্শককে মগজাস্ত্রও ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছেন না পরিচালকরা। বেশিরভাগ সময় তাই সিরিজগুলো শুরুতেই হয়ে যাচ্ছে প্রেডিক্টেবেল, অথবা অযথা দৈর্ঘ্যে ক্লান্তিকর। তাই 'বিঞ্জ'ও করছেন না দর্শকেরা। 


তিনটে ভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তিনটি থ্রিলার মুক্তি পেয়েছে। মুক্তির আগে প্রচারও হল বিস্তর। ডিজনি প্লাস হটস্টারে (Disney Plus Hotstar) পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়ার (Tigmanshu Dhulia) 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার' (The Great Indian Murder), নেটফ্লিক্সে (Netflix) মাধুরী দীক্ষিত (Madhuri Dixit) অভিনীত 'ফেম গেম' (Fame Game), অ্যামাজন প্রাইমে (Amazon Prime) মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty), শ্রুতি হাসান (Shruti Hassan) অভিনীত 'বেস্টসেলার' (Bestseller)। মিঠুন, শ্রুতি, মাধুরী সকলেই প্রথমবার ওয়েব সিরিজে কাজ করলেন। স্বভাবতই এঁদের দেখার জন্য দর্শকদের আগ্রহও ছিল। 


'বেস্টসেলার'-এর ট্রিটমেন্টের মধ্যে খানিকটা অভিনবত্ব থাকলেও 'ফেম গেম' আর 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার'-এর চিত্রনাট্য অতি দুর্বল। এরমধ্যে বলাই যায় যাঁরা 'দ্য় গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার' দেখেননি, তাঁরা অনায়াসে দ্বিতীয় সিজন দিয়ে শুরু করতেই পারেন। কারণ 'হু ডান ইট'-এর পথ ধরে এগিয়ে শেষে দেখা গেল, যে দুজনকে খুনি বলে সিবিআই আর পুলিশ ধরল তাদের গুলিতে ব্যবসায়ী ভিকি রাইয়ের মৃত্যু হয়নি। হয়েছে তৃতীয় কারও গুলিতে। কোনও দর্শকের বই পড়ার অভ্যাস থাকলে দ্বিতীয় সিজনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা না করে বিকাশ স্বরূপের 'সিক্স সাসপেক্ট' পড়ে ফেলতে পারেন, খুনি কে, তা জানার জন্য। কাহিনিতে দেখা যায়, ৩২ বছর বয়সী শিল্পপতি ভিকি রাই ছত্তিশগড়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জগন্নাথ রাইয়ের একমাত্র ছেলে, যে খুন হয়। কে খুন করল, উত্তর খোঁজার জন্য চিত্রনাট্যের যে বুনোট থাকা দরকার, তা একেবারেই উধাও। 'ডার্ক ডিজায়ার' বা 'সিনারে'-এর মত টানটান সিরিজের কথা বাদ দিলেও ভারতীয় প্রোডাকশনে সাম্প্রতিক মুক্তি পাওয়া পরমব্রত - রবিনা ট্যান্ডন অভিনীত 'আরণ্যক', বা ২০২০-র 'পাতাললোক'-এর মত আশা বা আগ্রহ নিয়ে দেখতে বসলে হতাশ হবেন। সিরিজে প্রাপ্তি বলতে পাওলি দাম আর রিচা চাড্ডার অভিনয়। যদিও দুজনের চরিত্রই স্টিরিওটাইপড। পুলিশ অফিসার রিচা হোক, বা অভিনেত্রীর ভূমিকায় পাওলি, পরিচালকের ভোট প্রতীক গাঁধী আর আশুতোষ রাণার দিকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। দুর্বল চিত্রনাট্যে ইতি আর নেতি চরিত্রের মধ্যে স্পষ্ট পিতৃতন্ত্রের ছাপ। ডিসিপি সুধা ভরদ্বাজের বুদ্ধিমত্তা কোনওভাবেই সিবিআই অফিসার সুরজ যাদবের আশেপাশে ঘেঁষতে পারে না। এমনকী দুর্নীতির কূটবুদ্ধিতেও পিছিয়ে সুধা। 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার'-এর গ্রেটনেস বলতে রঘুবীর যাদবের সাবলীল মোহন দাস থেকে মোহন কুমারের চরিত্রে যাতায়াত। তাও কিছুটা এগোনোর পর একঘেয়ে হয়ে যায়। দুর্বল চিত্রনাট্য ঢেকে দেয় পরিচালকের মুন্সিয়ানাও। 


আরও পড়ুন: Allu Arjun Update: 'একসঙ্গে পথ চলার ১১ বছর', স্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট অল্লু অর্জুনের


মাধুরী দীক্ষিত ওটিটিতে অভিনয় শুরু করলেন নেটফ্লিক্সের সিরিজ 'ফেম গেম' দিয়ে। অনামিকা আনন্দ একজন সফল অভিনেত্রী যার কেরিয়ার গ্রাফে আছে সাফল্য আর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থতা। স্বামী, মা সকলেই অনামিকার সাফল্যকে ব্যবহার করে। বিজয় নাম্বিয়ার ও করিশ্মা কোহলির পরিচালনায় এই সিরিজ দর্শক মনে দাগ কাটতে পারল না দুর্বল চিত্রনাট্য ও চরিত্রায়ণের জন্য। একজন সফল অভিনেত্রীর আত্মবিশ্বাস এত কম কেন? আর কর্মক্ষেত্রে সফল হতে গেলে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ হতেই বা হবে কেন? আবার, একটা অসফল বিয়ে শুধুমাত্র সন্তানদের মুখ চেয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, এমন চিরাচরিত সামাজিক নির্মাণই বা কীসের জন্য ২০২২-এর একটা সিরিজে সময় ব্যয় করে দেখতে হবে? এই সিরিজের প্রতিপদে রয়েছে ক্লান্তিকর আর অযৌক্তিক সমাজ-নির্মাণ। জীবনের থেকে কী প্রত্যাশা করেন, আগামীতে কী করতে চান, সবকিছুর জবাবে অনামিকার একটাই উত্তর, জানি না। একমাত্র ছেলের মানসিক অবসাদের কারণ খোঁজার মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা নজরে পড়ে। কিন্তু তার যৌনতার পরিচয় জানার পরই মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়া ও যুক্তি হিসাবে বাইপোলারের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসিয়ে দেওয়া এক কথায় 'প্রেডিক্টেবল'। বলা যায় খানিক বিরক্তিকরও। বিখ্যাত অনামিকার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াকে ঘিরে রহস্য আর তার উদঘাটনও অনাবশ্যক দীর্ঘায়িত। এখানেও রয়েছেন একজন মহিলা পুলিশ অফিসার এবং তিনিও অনাবশ্যক বেশি সময় নিচ্ছেন ও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বলে তাঁকেও দাগিয়ে দিলেন তাঁর বস। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ক্রাইসিসে অফিসের ফোন নিতে না পারা দিয়ে অনায়াসে পিতৃতন্ত্রের পক্ষে বার্তা দিয়ে দিলেন পরিচালক। এই সিরিজ দেখে দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগবেই, কার কাছে পরিচালকদ্বয় দায়বদ্ধ? দর্শক না ওটিটির স্থির করে দেওয়া দৈর্ঘ্য? মাধুরীর আর মানব কলের অভিনয়ও সিরিজের দুর্বলতা ঢাকতে ব্যর্থ হয়েছে। মানব কলকে দেখে বারবার তাঁর 'নেলপলিশ'-এর অভিনয় মনে পড়বে, আর তা আরও স্পষ্ট করে দেবে এই সিরিজের দুর্বলতা। 


'বেস্টসেলার'-এর কাহিনির আবর্তন থেকে বুনোট, এই দুই সিরিজের তুলনায় অনেকটাই শক্তিশালী। এই সিরিজের এপিসোডিক ট্রিটমেন্টে বইয়ের মত চ্যাপ্টার ভাগ আর পর্ব শেষে কোনও এক চরিত্রকে দিয়ে চ্যাপ্টার নম্বর বলিয়ে দেওয়া, সিরিজে নতুনত্ব যোগ করে যা প্রশংসার দাবি রাখে। গল্পের গতি অনুমানযোগ্য হলেও শেষ পর্যন্ত দর্শককে ধরে রেখেছেন পরিচালক মুকুল অভ্যওঁঙ্কর।  সিরিজ জুড়ে নানা সময়ের বৃত্তে ঘোরাফেরা করেছে কাহিনি। কিন্তু অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে ফের অতীত... এই যাতায়াতটা সাবলীল ভাবে সামলেছে সিরিজটির চিত্রনাট্য। শুরুতে শ্রুতি হাসানের অভিনয় কিছুটা আরোপিত মনে হলেও পরে গল্পের ছন্দে সাবলীল লেগেছে শ্রুতিকে। এতদিন পর মিঠুন চক্রবর্তীকে দেখার আগ্রহ ছিল ভক্তদের। বলাই যায় এসিপি লোকেশ প্রামাণিকের চরিত্রে নিজেকে ঢেলে সাজিয়েছেন মিঠুন যা দর্শকদের মনে থাকবে অনেকদিন। সিরিয়াস অভিনয়ের পাশাপাশি এই সিরিজে কমিক এলিমেন্টও যোগ করেছেন মিঠুন, তাঁর অনবদ্য স্টাইলে। সিআইডি-র দুঁদে অফিসার ফুড ব্লগিং করছেন, ভিডিওয় বলতে ভুলে যাচ্ছেন লাইকের পর সাবস্ক্রাইব করার কথা। যে কোনও জায়গার ভাল খাবারের সন্ধান তাঁর নখদর্পণে। রসনাবিলাসী বাঙালির এই বৈশিষ্ট্য লোকেশের চরিত্র মিঠুন দুর্দান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভোর চারটের সময়ও তাঁকে দেখা গিয়েছে এক বাটি নুডলস নিয়ে দফতরে বসে রয়েছেন। আর যখন সন্দিগ্ধ অপরাধী তাঁর সামনে বসে, তখন কথা বলেছে তাঁর চোখ। এই সিরিজে গওহর খানের অভিনয়ও বড় প্রাপ্তি। তাহির ওয়াজিরের চরিত্রে সাবলীল অর্জুন বাজওয়াও। শ্রুতির পাশে মিনু মাথুরের ভাই গোগোর চরিত্রে সত্যজিৎ দুবেকে খানিকটা দুর্বল লাগে। তবে সব মিলিয়ে বলা যায়, 'বেস্টসেলার' দর্শকের মন ছুঁয়ে যাবে, কাহিনির শেষে রয়ে যাবে ভাল লাগার রেশ।


আরও পড়ুন: Netflix Ban in Russia: রাশিয়ায় পরিষেবা স্থগিত করল নেটফ্লিক্স


শুক্রবার রিলিজ হয়েছে 'রূদ্র: দ্য এজ অব ডার্কনেস', 'আনদেখি সিজন টু', 'সুতলিয়াঁ'। আগামীতে মুক্তির অপেক্ষায় 'ব্লাডি ব্রাদার্স', 'দিল্লি ক্রাইম সিজন টু', 'স্ক্যাম টু থাউজ্যান্ট থ্রি'-এর মত সিরিজ। দর্শক আকর্ষণে এই সিরিজগুলো 'মির্জাপুর' বা 'ইনসাইড এজ'-এর মতই সফল হল কি না, বলবে সময়।