কলকাতা: অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে- সম্প্রতি একটি আইনি প্রক্রিয়ায় এমনটা জানিয়েছেন খোদ কোভিড টিকা প্রস্তুতকারক অ্যাস্ট্রাজেনেকা। তারা জানিয়েছে তাদের কোভিড টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে TTS- হতে পারে। 


কী এই TTS?
এর পুরো নাম- Thrombosis with Thrombocytopenia Syndrome. এটি এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে, প্লেটলেটের সংখ্যা কমে যায়। সম্প্রতি অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা-সংক্রান্ত এই খবরের পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু পোস্ট দেখতে পাওয়া গিয়েছে। একাধিক পোস্টে ভারত সরকারকে আক্রমণ করা হয়েছে কোভিশিল্ডকে ভারতে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ার জন্য। কোভিশিল্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি কোভিড টিকার ভারতীয় ভার্সন। সেরাম ইন্সটিটিউট ভারতে কোভিশিল্ড তৈরি করেছিল। 


সম্প্রটি অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর সামনে আসতেই কোভিশিল্ড নিয়ে চরম আতঙ্কের একটি ছবি তৈরি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া একাধিক পোস্টের দাবি করা হচ্ছে- এখন অধিকাংশ ভারতীয় TTS-এর বিপদের মুখে রয়েছে। এটা কি আদৌ সত্যি? THIP-এর ফ্যাক্ট চেকে যা উঠে এসেছে- তাতে এই দাবি অর্ধ সত্য। TTS-এর বিপদের ঘটনা সত্যি হলেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম (Very Rare)  


কী দাবি করা হচ্ছে?
একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে ভারত সরকারকে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে ভারতে কোভিশিল্ড ব্যবহারে অনুমতি দেওয়ার জন্য। দাবি করা হচ্ছে, এই অনুমতির কারণেই ভারতের জনগণ কোভিড টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে TTS-বিপদে পড়তে পারে। UK-এর আদালতে AstraZeneca-এর দাবির উপর ভিত্তি করে এমন অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এরমনই একটি পোস্ট রইল নীচে।


 






Fact Check:


TTS আসলে কী? এর উপসর্গ কী?
Thrombosis with Thrombocytopenia Syndrome (TTS)- আদতে একটি গুরুতর শারীরিক পরিস্থিতি। এমন হলে শরীরে প্লেটলেটের সংখ্যা কমে (Thrombocytopenia) যায় এবং অন্যদিকে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে (Thrombosis)। এর উপসর্গ একাধিক। শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া, টানা মাথা ধরে থাকা, পেট ব্যথা- এর উপসর্গের তালিকায় রয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তির সহজেই চোট আঘাতের দাগ (bruising) হতে পারে  


AstraZeneca-এর কোভিড টিকায় সত্যি TTS হয়?


এর উত্তর- হ্যাঁ হতে পারে। কিন্তু তার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ (Very Rare Side Effects)। এটা খুব স্পষ্ট যে সংস্থার তরফে যা জানানো হয়েছে এবং এর আগের গবেষণাগুলি থেকে যা তথ্য উঠে এসেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে- যাঁরাই অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড টিকা নিয়েছে তাঁরাই TTS-এ আক্রান্ত হবেন এমন নয়।  



বহুজাতিক ওষুধ সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা এটা জানিয়েছে যে এই কোভিড টিকা, AZD1222-এর কারণে প্লেটলেট কমে যাওয়া এবং রক্ত জমাটের মতো সমস্যা খুব খুব কম সংখ্যায় হলেও হতে পারে। এই কোভিড টিকা এবং TTS-এর মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে প্রস্তুতকারক সংস্থার তরফে। সংস্থার বিরুদ্ধে UK-এর আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়েছে- সেখানেই মামলার শুনানিতে এমনটা জানিয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এই কোভিড টিকা এবং ভারতে কোভিশিল্ড নামে তৈরি কোভিড টিকা- একেবারে এক। 


আইনি প্রক্রিয়ায় সংস্থার তরফে নথিতে দাবি করা হয়েছে যে TTS-হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা 'rare' এবং 'uncommon' 


অ্যাস্ট্রাজেনেকা - ব্রিটিশ-সুইস ওষুধ সংস্থা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল এই কোভিড টিকা। ওই টিকাই ভারতে কোভিশিল্ড নামে তৈরির জন্য ছাড়পত্র পায় সেরাম ইন্সটিটিউট। ওই একই টিকা ইউরোপের বাজারে বিক্রি হয়েছে Vaxzevria- নামে। অর্থাৎ এই সব টিকার ফর্মুলা একেবারে এক- শুধু এলাকা এবং প্রস্তুতকারক সংস্থা ভেদে ব্র্যান্ডনেম বদলে গিয়েছে।


অ্য়াডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন- শ্রেণিতে পড়ে AstraZeneca-এর তৈরি এই টিকা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করে এই টিকার ২ ডোজের পরে কোভিডের বিরুদ্ধে ৬০%-৮০% সুরক্ষা দিয়েছে।



AstraZeneca-এর টিকাই কি একমাত্র যার সঙ্গে TTS-বিপদ জুড়ে রয়েছে?


এর উত্তর - না। অন্য কোভিড টিকার সঙ্গেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে TTS-এর বিপদ রয়েছে। Johnson & Johnson’s-এর কোভিড টিকার নাম Janssen- এতেও এই সমস্যা হওয়ার বিপদ রয়েছে। ২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর বেসড টিকাগুলির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে TTS হতে পারে।


২০২৩ সালে Yale University-এর হেমাটোলজিস্ট রবার্ট বোনা (Robert Bona)- একটি রিপোর্টে বলেছেন, 'এই ধরনের জমাট বাধার ঘটনা সাধারণত তাঁদের হতে পারে, যাঁরা শয্যাশায়ী, হাসপাতালে ভর্তি অথবা প্রদাহ-সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত অথবা ক্যান্সার আক্রান্ত।' ফলে এখনও এই বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত কোনও তথ্য হাতে নেই। 


ভারতের জনগণ কি TTS-এর বিপদে রয়েছে?


খুব সামান্য। কিন্তু এই নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনও কারণ নেই।


ভারতে যে যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে- তার মধ্যে Covishield- সবথেকে বেশি ব্যবহৃত। গত কয়েকবছরে সারা দেশে TTS-এর ঘটনা খুবই সামান্য সামনে এসেছে। যদি এই কারণে বড় সংখ্যায় অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটত তাহলে তা সংবাদমাধ্যমের নজরে আসত- সেই হারে খবরও করা হতো। 


এছাড়া এটাও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন যে, Thrombosis with Thrombocytopenia syndrome (TTS) এবং তার সঙ্গেই ভ্যাকসিন থেকে হওয়া vaccine-induced immune thrombotic thrombocytopenia-  খুবই কম সংখ্যায় হয়ে থাকে (extremely rare side-effect)। এই সমস্যা মূলত টিকাকরণ হওয়ার কিছু সময় পরেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এর আগে যা গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে- টিকা থেকে হওয়া CVST-এর মতো সমস্যা ভারতে এখনও পর্যন্ত নথিভুক্ত হয়নি।


কোভিড মহামারি ঠেকানোর জন্য কোভিড টিকাকরণ অত্যন্ত কার্যকরী এবং নিরাপদ মাধ্য়ম হিসেবে কাজ করেছে। তবুও খুব সামান্য হলেও TTS বা VITT-এর মতো সমস্য়া দেখা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এটাও ঠিক যে টিকার নিরাপত্তা সংক্রান্ত দিকগুলি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সর্বদা যাচাই করে নেয়। সব ভারতীয় TTS-এর বিপদের মুখে রয়েছে বা এই টিকায় অনুমোদন দিয়ে সরকারি স্তরে ভুল করা হয়েছে বললে তা অতিরঞ্জিত এবং বিভ্রান্তিমূলক হবে।


The Healthy Indian Project (THIP)- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্য়াকসিন সেফটি নেটওয়ার্কের (VSN) সদস্য। ইতিমধ্যেই THIP-এর তরফে সোশ্য়াল মিডিয়ায় ছড়াতে থাকা কোভিড টিকা সংক্রান্ত একাধিক তথ্যের ফ্যাক্ট চেক করা হয়েছে। 


সব টিকাতেই কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে?
অধিকাংশ টিকার ক্ষেত্রেই অল্পস্বল্প পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। জ্বর বা ব্যথার মতো সমস্যা সাময়িক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা মনে করেন, টিকায় যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে তার তুলনায় সুবিধা ও লাভ অনেকটাই বেশি হয়। 


World Health Organization (WHO)-এর তরফে বলা হয়েছে- 'টিকা একদম নিরাপদ'। যে কোনও ওষুধের মতোই টিকাতেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। যদিও তা খুবই অল্প সময়ের জন্য এবং অল্প। অনেকসময় অল্প জ্বর ও হাতে ব্যথা হতে পারে। আরও বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত খুব অল্পই দেখা যায়। 


কোভিশিল্ড-এ টিকা নিলে কি উদ্বেগ রয়েছে?


এখনই সেভাবে উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। ANI-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে IMA-এর কো-চেয়ারম্যান Dr. Jayadevan  বলেছেন, 'কিছু বিশেষ ধরনের টিকা এবং আরও কিছু কারণের জন্য এই ধরনের ঘটনা কদাচিৎ ঘটতে পারে।' এছাড়াও আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। যখনই TTS- এর ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে- সেটা টিকাকরণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। ফলে সাবধান থাকা উচিত এবং কোনওরকম সমস্যা হলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। 


এই ফ্যাক্ট চেক আর্টিকলটি দি হেলদি ইন্ডিয়ান প্রজেক্ট কর্তৃক প্রকাশিত এবং এবিপি লাইভ বাংলা দ্বারা অনুবাদিত এবং অনুলিখিত।


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে। 


আরও পড়ুন: রাত পোহালেই মাধ্যমিকের ফল, wb10.abplive.com ক্লিক করলেই জানা যাবে রেজাল্ট