সুমিত পাণ্ডে, নয়াদিল্লি:১৩ জুলাই, ২০২২। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হাত ধরে খবর ছড়াল, সামরিক বিমানে করে দেশ ছেড়েছেন শ্রীলঙ্কার (sri lanka) তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (president) গোতাবায়া রাজাপক্ষে (gotabaya rajapaksa)। অমানুষিক আর্থিক সঙ্কটে দ্বীপরাষ্ট্র তখন উত্তাল। তবে সেই সঙ্কট কলম্বোর প্রেসিডেন্ট প্যালেসের দরজায় কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দূর-দূরান্তে তার প্রতিধ্বনি শোনা যেতে শুরু করে। বিশেষ করে পক প্রণালীর পারে তামিলনাড়ুতে প্রথম পর্যায়ে 'অর্থনৈতিক উদ্বাস্তু' হিসেবে যাঁরা এলেন, তাঁদের চোখেমুখে সেই ধাক্কা যেন আরও বেশি স্পষ্ট। সম্ভবত সেই লগ্নেই ভারত টের পেয়েছিল, পড়শি রাষ্ট্রের এই দুর্দিনে মুখ ঘুরিয়ে থাকা যাবে না।


ইতিহাস...
আশির দশকের স্মৃতি স্বাভাবিক ভাবেই ফিরে আসে এই সময়। সে বার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী ও সংখ্যালঘু তামিলদের জাতিগত যুদ্ধের জের ছলকে এসেছিল ভারতে। এবারও বাদ গেল না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সম্ভবত সে কারণেই এ বার নিজে থেকে শ্রীলঙ্কার সঙ্কট নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল ভারত। প্রতিবেশির দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় ঠিকই, তবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যে নাক গলানো হবে না সেই বার্তাও স্পষ্ট করে দেয়। এই আর্থিক সঙ্কট শুধু শাসক ও প্রভাবশালী নয়, শ্রীলঙ্কার জনসাধারণের কাছেও পৌঁছানোর সুযোগ করে দিয়েছিল ভারতকে। এবং সেই সুযোগে জ্বালানি আমদানির জন্য ক্রেডিট লাইন এবং বৈদেশিক রিজার্ভ শুকিয়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের জন্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা পাঠিয়ে প্রতিবেশির পাশে দাঁড়ায় নয়াদিল্লি। শুধু তা-ই নয়। আন্তর্জাতিক মানিটারি ফান্ড এবং বিশ্বব্যাঙ্কের সঙ্গে ঋণের পুনর্গঠন ও আর্থিক সহায়তার জন্য আলোচনার শেষ পর্যায়ে পৌঁছনোর মধ্যেই ভারত তার 'প্রতিবেশি প্রথম নীতি '-র উপর জোর দেয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কিন্তু চিনের মতো অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বাধ্যবাধ্যকতার উপর নির্ভরশীল নয়। দু-দেশের যোগাযোগ অনেকাংশেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ের।


শেষ দু-দশকে চিনের প্রভাব...   
গত দু'দশকে অবশ্য কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক, দুটি ক্ষেত্রেই  শ্রীলঙ্কায় ড্রাগনের প্রভাবের লাগাতার বাড়তে দেখা গিয়েছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে, কার্নেগি সেন্টারের মতো আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দক্ষিণ-এশিয়ায় চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। লেখা হয়, এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য বৈচিত্র্যে ভরা কৌশল ব্যবহার করছে বেজিং যার অন্যতম প্রশাসনের মূল মুখদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, প্রায় দু-দশক আগে মাহিন্দা রাজাপক্ষে পরিবারের উত্থানের সঙ্গেই পক প্রণালী জুড়ে শ্রীলঙ্কায় কৌশলগত বিনিয়োগ গতি পেয়েছে। সিংহলী জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে রাজাপক্ষেরা ক্ষমতা আসেন। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলিতে তামিল বিদ্রোহকে দমন করাই অন্যতম লক্ষ্য ছিল তাঁদের। সেই সময় শ্রীলঙ্কার সামরিক বাহিনীকে নিয়মিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে এলটিটিই-র বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠে চিন। কূটনৈতিক ভাবেও পাশে দাঁড়ায় তারা। সব মিলিয়ে কমিউনিস্ট শাসকদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ব্যক্তিগত এবং কূটনৈতিক দু-ধরনের সম্পর্কই গড়ে ওঠে।
বদলে শ্রীলঙ্কা বন্দর এবং বিমানবন্দরের মতো বিলাসবহুল প্রকল্পের চিনা বিনিয়োগের দরজা খুলে দেয়। তবে সেই বিনিয়োগ এমনিই আসেনি। সালটা ২০২০। চিনের কাছে বৈদেশিক ঋণের ভার বাড়ায় দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ বেড়ে যায় শ্রীলঙ্কায়। 
ড্রাগনের এই ক্রমবর্ধমান প্রভাবের পরিণতি বুঝেছিল শ্রীলঙ্কা। বরং বলা ভাল বুঝেছিল আরও বছরতিনেক আগে। ২০১৭ সালে গভীর-জলের হাম্বানটোটা বন্দর চিনের হাতে তুলে দিতে কার্যত বাধ্য হয় তারা। লক্ষণীয় বিষয় এর ঠিক দু বছর আগেই, ২০১৫ সালে, মৈত্রীপালা সিরিসেনার কাছে হঠাৎ হারতে হয়েছিল মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে। ঘটনার মোড় ভারতকে আরও এক বার তার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক ঝালাই করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পরে, ফের বদলে যায় ছবিটা।
হালের তীব্র আর্থিক সঙ্কট আবার নাগরদোলায় চাপিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। গণরোষের মুখে ক্ষমতাচ্যুত রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। এমন সময়ে সিংহলীদের পাশে দাঁড়িয়ে ভারত সার্কের অন্যান্য সদস্যদের কাছে একটি ইতিবাচক বার্তা পাঠাবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিশেষ করে নেপাল, মলদ্বীপ এবং বাংলাদেশে। ঘটনাচক্রে এই তিন দেশেও গত দুই দশক ধরে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। 


আরও পড়ুন:'জীবনে অনৈতিক কাজ করিনি, প্রমাণ হলে নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দেব', বললেন ফিরহাদ