মায়ের কাছে বকা খেয়ে মন খারাপ ছোট্ট তিন্নির। রেজাল্ট খারাপে একেবারে মনমরা হয়ে গিয়েছে কলেজ পড়ুয়া সূর্য। এমন টুকরো মন খারাপের সঙ্গে খুব ছোট থেকেই পরিচিত আমরা। তবে অবসাদ? নাহ, মন খারাপ আর অবসাদ কিন্তু একেবারেই এক নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে চূড়ান্ত মানসিক অবসাদকেও মন খারাপ বলে ভুল করেন সাধারণ মানুষ। আর যার ফলাফল হতে পারে মর্মান্তিক। কোনটা নেহাতই মন খারাপ, কোনটা অবসাদ? বুঝবেন কীভাবে? সতর্কই বা হবেন কখন? দীর্ঘ অবসাদ এবং সাময়িক মনখারাপ এই দুটি বিষয় কি একই? এবিপি ডিজিটালকে সমস্ত প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিলেন কনসালট্যান্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবলীনা মিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সব্যসাচী মিত্র।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা বলছে, অবসাদ হল একটি সাধারণ মানসিক অস্বাভাবিকতা। মনখারাপ আর ডিপ্রেশনের পার্থক্য কোথায়? ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবলীনা মিত্র চট্টোপাধ্যায় বলছেন, 'হঠাৎ কোনও কাজে ব্যর্থতা, অফিসে বা পরিবারে কোনও সমস্যা, সঙ্গী বিচ্ছেদ বা প্রিয়জনের মৃত্যুতে কয়েকদিন মন বিক্ষিপ্ত বা বিষণ্ণ হতেই পারে। তবে তা নিজে থেকেই তা ঠিক হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে এ রকম মন খারাপ কিন্তু ডিপ্রেশন নয়। তবে টানা দু-সপ্তাহ বা তার বেশি সময়ে মানসিক অস্থিরতা চলতে থাকলে তাকে অবসাদের আওতাভুক্ত করছেন চিকিৎসকরা। বলছেন, মায়ের বকা, বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়ায় মনখারাপ স্বাভাবিক মানসিক পরিস্থিতি। এর প্রকাশও এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ। তবে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বা অবসাদ সাধারণ মন খারাপের থেকে অনেক বেশি গভীর এবং জটিল। যা একা একা সামাল দেওয়াও সম্ভব নয়, প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ।
অন্যদিকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সব্যসাচী মিত্র বলছেন, অবসাদের প্রথমদিকে রোগী মানসিক সমস্যা টের পেলেও, অস্থিরতার মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই বোধশক্তিও লোপ পায়।
অবসাদের বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে, সেগুলো কী কী
- দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা।
- পছন্দের কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে অসমর্থ বোধ করা।
- মনঃসংযোগ কমে যাওয়া।
- খিদে নষ্ট হওয়া, বেশি বা কম ঘুম।
- যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে দোষী মনে করা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব।
- ঘুম কমে যাওয়া, ঘুম আসায় অসুবিধে, এলেও বারবার ভেঙে যাওয়। বিশেষত ভোরের দিকে ঘুম ভাঙার প্রবণতা।
- আত্মহত্যার প্রবণতা।
ঝুঁকিতে কারা
অবসাদের শিকার হতে পারে যে কোনও বয়সই। তবে ২৫ থেকে ৪৫ বছর এই সময়টাই সর্বাধিক ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে রয়েছে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় ঝুঁকি বেশি মহিলাদেরই।
বেঙ্গালুরুর নিমহ্যান্স (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস) বারোটি রাজ্যে ৩৪,৮৯৭ জন মানুষের উপরে একটি সমীক্ষা করে। আশঙ্কাজনকভাবে তাতে দেখা গিয়েছে, ভারতে মানসিক রোগে সব চেয়ে বেশি ভোগেন সমাজের দরিদ্র অংশ। দারিদ্রের সঙ্গে মানসিক অবসাদের সরাসরি যোগাযোগ উঠে এসেছে একাধিক গবেষণায়। অন্যভাবে দেখতে গেলে, এই মানসিক অসুস্থতার জন্যই কমতে থাকে কর্মক্ষমতা এবং রোজগারও। অর্থাৎ দুই-এ মিলেই তৈরি হয়েছে চক্রবূহ।
আগে থেকে অবসাদ প্রতিরোধের উপায় কি নেই? চিকিৎসকরা বলছেন, রুটিন মেনে চলা, সৃষ্টিশীল হওয়া, স্বাস্থ্যকর খাওয়া-দাওয়া, সদর্থক চিন্তা করা, নেতিবাচক মানুষ এড়িয়ে চলা, যোগব্যায়াম করা, পরিচ্ছন্ন থাকা, ভাল বই পড়া, আট ঘণ্টা ঘুম ইত্যাদি সুস্থ জীবনযাপন করলে অবসাদ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
উল্লেখ্য, সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ২০ কোটি মানুষ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এঁদের মধ্যে আবার ৪.৫ কোটির উপরে মানুষ ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার ও ৪.৪ কোটি মানুষ অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের শিকার। অথচ মনের অসুখ নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই উদাসীন। অবসাদকে স্রেফ মনখারাপের মোড়কে আমলই দেন না বেশিরভাগ মানুষ। তবে সচেতন হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব