কলকাতা: ছোটবেলার ঠিকানা ছিল ল্যান্সডাউন। পাশেই পদ্মপুকুর। চৈত্রের শেষে সেখানে চড়কের মেলা বসত। সেই মেলার পুতুল বিক্রেতারা জিনিসপত্র রেখে যেতেন তাঁদের বাড়িতে। তখন চুপিচুপি চুক্তি হয়ে যেত। মেলা চলাকালীন পুতুল ছোঁবেন না, ভাঙবেন না। কিন্তু যাওয়ার সময় একটা করে পুতুল দিয়ে যেতে হবে বিক্রেতাদের। সেটা নিয়েই সারা বছরের খেলা। 'বিক্রেতারা কথা রাখতেন, কিন্তু আমাদের অমোঘ আকর্ষণ। মাঝে মাঝেই ঝুড়ি ফাঁক করে দেখতাম.. একটা মানুষ.. একটা হরিণ..একটা ফলের থালা..' সরল স্বীকারোক্তি খরাজ মুখোপাধ্যায়ের।


নববর্ষের স্মৃতি বলতেই খরাজের মনে ভিড় করে আসে চড়কের মেলা, সেলের জামা কাপড়, মিষ্টির বাক্স, পাড়ার নাটক, আরও কত কী! এবিপি লাইভকে অভিনেতা বললেন, 'আমাদের বাড়িতে কেউ ব্যবসায়ী ছিলেন না। কাজেই হালখাতার কোনও আয়োজন হত না। তবে বাবা উকিল ছিলেন। সেই সূত্রে অনেকে বাবাকে মিষ্টির প্যাকেট পাঠাতেন। অনেক সময় নিমন্ত্রণও থাকত। সেখানে গেলে বাবার হাত দিয়ে মিষ্টির প্যাকেট পাঠাতেন তাঁরা। আমাদের উৎসাহ ছিল কতগুলো মিষ্টি এল সেটা হিসেব করা। বেশিরভাগ সময়ই খেয়ে শেষ করে উঠতে পারতাম না। নববর্ষের আগে মা, দিদিরা কেনাকাটা করতে যেতেন। আমাদের জন্য সাধারণ সুতির জামা নিয়ে আসতেন। তাতেই কী আনন্দ।'


নববর্ষে পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। অভিনয় থেকে শুরু করে জোগাড়, খরাজ সবকিছুতে অগ্রগণ্য। সেই স্মৃতি উস্কে অভিনেতা বলছেন, 'প্রত্যেকবার অনুষ্ঠানে এক একটা মজার ঘটনা ঘটত। কোনোবার বাড়ির পর্দা খুলে নিয়ে গিয়ে মঞ্চে লাগাতাম। কখনও আবার কারও বাড়ি থেকে আলো জোগাড় করে আনা হত। একবার একটা দৃশ্য ছিল তলোয়ার চালানোর। সেটা করতে গিয়ে মঞ্চের মধ্যেই তলোয়ার দু-টুকরো। আমরা প্রথম নাটক করেছিলাম রবি-শশী-তারা। সেখানে আমার ছোড়দাকে মেয়ে সাজানো হয়েছিল। দৃশ্যে ছিল, ছোড়দা রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে আসবে। বড়দা সেখান থেকে রসগোল্লা খাবে। যথরীতি অভিনয় চলছে। ছোড়দা হাঁড়ি হাতে হাজির। বড়দা তাতে হাত ঢুকিয়েই অবাক। মঞ্চেই বলে ফেললেন, একি.. রসগোল্লাই তো নেই। খাব কী! কেউ আগে থেকেই রসগোল্লার হাঁড়ি খেয়ে সাফ করেছিল। আমরা টের পাইনি। আমিও একাধিকবার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি।'


'তুলসি তুলসি বৃন্দাবন/তুমি তুলসি বৃন্দাবন/তোমার শিরে ঢালি জল/অন্তিমকালে দিও স্থল' ছোটবেলায় বাবার বলা সেই পদ্য আজও কানে বাজে খরাজের। চৈত্রমাসে এই মন্ত্র পড়েই তুলসী মঞ্চে জল ঢালতেন বাবা। দেখাদেখি তিনিও। আফশোসের সুরে বললেন, 'এখন সব রীতিনীতিগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে আমাদের বাড়িটা একটু আধ্যাত্মিক। ঘটনাচক্রে আমার বউ, ছেলে দুজনেই বেশ আস্তিক। আমার ছেলেকে যেমন বাঙালি রীতিনীতিগুলো শেখানোর চেষ্টা করেছি। ও ধুতি পরতে পারে। যেমন ভালো ড্রাম বাজায়, তেমনই ভালো খোলও বাজায়। আমরা পরের প্রজন্মকে না শেখালে বাঙালি সংস্কৃতি বাঁচবে কী করে!'