তানিয়া চক্রবর্তী, কলকাতা: আকাশজুড়ে তখন আগুনরঙা উৎসব। রাত শেষের পূব আকাশে হালকা আলোর আভা। সেই আভার মধ্যেই ক্যানভাসে ফুটে উঠল সোনালি রেখা। কাঁচা ডিমের কুসুম রঙের কাঞ্চনজঙ্ঘা। দার্জিলিং, কার্শিয়ঙ থেকে এদৃশ্য একেবারেই চেনা। কিন্তু, ডুয়ার্স-তরাই থেকে এমন ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন? হ্যাঁ, তা সম্ভব। একদিকে সবুজের গালিচা, অন্যদিকে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা, দুই নয়নাভিরাম দৃশ্য একই ক্যানভাসে।
জায়গাটা ঝান্ডি। কালিম্পং জেলার পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট এক জনপদ। ২০১৭ সালে কালিম্পং পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আগে ঝান্ডি ছিল জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সের একটি অংশ। এর ভৌগলিক অবস্থান এমন যে একদিকে কালিম্পং, অন্যদিকে ডুয়ার্স।একদিকে মেঘ-পাহাড়, অন্যদিকে নদী-জঙ্গল। একদিকে অনন্ত নীল, অন্যদিকে সবুজের সমারোহ। চারদিকে গগনচুম্বী পাহাড়ের সারি। তারই মাঝে বিস্তীর্ণ ডুয়ার্সের সবুজ উপত্যকা।
মালবাজার থেকে গরুবাথান হয়ে ঝান্ডির পথ। পথের দু’ধারে সাজানো চা বাগান। পাহাড়ি পথের সঙ্গী তিস্তার শাখানদী চেল। গরুবাথানের পর থেকেই চড়াই-উতরাই। মেঘের আবডাল সরিয়ে পাকদণ্ডী পথ চলে গেছে পাহাড়-চূড়োয়। পিচের রাস্তা পুরোটাই মসৃণ নয়। কিছু জায়গা বেশ খারাপ। সেই পথ বেয়ে সন্ধের কিছু আগে পৌঁছে যাওয়া যায় ঝান্ডিতে। দূরের নীল পাহাড়ের কোলের দিকে তখন হাত বাড়িয়েছে সূর্য। আলোর শেষ রেখা মুছে যাওযার আগে পর্যন্ত, আকাশে রঙের ম্যাজিক। তার সঙ্গী ঘরে ফেরা পাখির কলতান। ঝান্ডিতে খুব বেশি হোটেল নেই। হাতে গোণা কয়েকটি হোম স্টে। আর রয়েছে ঝান্ডি ইকো হাট। পাহাড়ের ধাপে ধাপে খুব সুন্দর কয়েকটা কটেজ। সেখানেই সবকিছুর বন্দোবস্ত রয়েছে।
ক্রমে সন্ধে হয়। রাতের ঝান্ডির এক অন্য মায়া। অদ্ভুত নির্জনতা। মাথার ওপর অনন্ত ছায়াপথ, সেই সঙ্গে একরাশ নৈঃশব্দ। জঙ্গলের বুনো গন্ধ, রাতচরা পাখির ডাক। দূর পাহাড়ের গায়ে একে একে জ্বলে উঠল জোনাকির মতো ঘরবাড়ির আলো। চাঁদনি রাতে হঠাৎ যেন কোনও এক ঘুমের দেশে চলে গেল ছোট্ট গ্রামটা।
ভোরে উত্তর-পশ্চিম কোণে যথাসময় হাজির কাঞ্চনজঙ্ঘা। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বরফশুভ্র পর্বত চূড়োর সৌন্দর্য উপভোগ, নিচে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী, সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। একটু অ্যাডভেঞ্চার চাইলে যেতেই পারেন গীত ঝোড়া। জঙ্গলের সর্পিল পথ ধরে ৪-৫ কিলোমিটার। নদীতে পা ডুবিয়ে, ছবির মতো হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ফার্নের ছায়া ঘেরা পাহাড়ি পথ। মেঘ-রোদ্দুর কুয়াশার লুকোচুরি। আশপাশে অসংখ্য নাম না জানা ফুলের গাছ। প্রচুর পাখির কলতান। প্রকৃতির মতোই সমৃদ্ধ পাহাড়ি মানুষগুলোর মন। পাহাড়ের কোলের মতোই আতিথেয়তায় ভরিয়ে দেন তাঁরা। ওঁরা নিজেদের মধ্যে নেপালি ভাষায় কথা বললেও, বাংলা, হিন্দি স্পষ্ট বুঝতে পারেন। অনেকটা বলতেও পারেন। এখানে এমনিতে কোনও খাবারের দোকান নেই। ইকো হাট কিম্বা হোম স্টেতে পাহাড়ি খাবারদাবার, যেমন মোমো, থুকপা, এসব পাওয়া যায়। বললে ভাত, ডাল, দেশি মুরগীর ঝোলও বানিয়ে দেন। চাইলে বাঁশ পোড়া মুরগির মাংসও পাওয়া যেতে পারে।
দ্রষ্টব্য স্থান: এখান থেকে খুব কাছেই রয়েছে পর্যটকদের প্রিয় কয়েকটি জায়গা। লাভা, লোলেগাঁও, কোলাখাম, রিশপ। নেওড়া ভ্যালির জঙ্গলও খুব দূরে নয়। একেবারে নিঃঝুম এলাকা থেকে লোকালয়ে যেতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন কালিম্পং টাউন। আবার যদি পাহাড় ছেড়ে ডুয়ার্সের সবুজ উপত্যকায় ঘুরে আসতে চান, তবে যেতেই পারেন সামসিং, সুনতালেখোলা, রকি আইল্যান্ড, সাখাম ফরেস্ট, গরুমারা, মূর্তি, চাপড়ামারি।
কীভাবে যাবেন?
আকাশপথে বাগডোগরায় নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঝান্ডি। রেলপথে গেলে নামতে হবে নিউ জলপাইগুড়ি কিম্বা মালবাজার স্টেশনে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করতে হবে। ঝান্ডি ইকো হাটে আগে থেকে জানিয়ে রাখলে, তারাও গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়।
যাওয়ার আদর্শ সময়:
ঝান্ডি যেকোনও ঋতুতেই অপূর্ব। তবে, খুব ঠান্ডায় বয়স্কদের কষ্ট হতে পারে। বর্ষায় ঝান্ডির অপরূপ রূপ। অবিরাম জলধারা, সঙ্গে পাহাড়ি নদীর স্রোত, সে এক নৈসর্গিক প্রকৃতি। কিন্তু, বর্ষায় পাহাড়ি খারাই পথ বেশ বিপজ্জনক। সেই সঙ্গে জোঁক ও পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়ে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে কিম্বা সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের শুরু, প্রকৃতিকে উপভোগ করার আদর্শ সময়।
কোথায় থাকবেন?
ঝান্ডিতে খুব বেশি হোটেল নেই। কয়েকটি হাতে গোণা হোমস্টে। এছাড়া আছে ইকো হাটের বেশ কয়েকটি কটেজ ও গ্লাস হাউজ। অনলাইনেই সেগুলি বুক করা যায়।
নিরিবিলিতে পুজোর ছুটি কাটাতে চাইলে, তিন চার দিন হাতে নিয়ে ঝটপট বেরিয়ে পড়তেই পারেন ঝান্ডির উদ্দেশে।